অল্প স্বল্প গল্প
11 April 2017 Blog
আরেকটি সাদা পালক
– ইসমাত সুলতানা
প্রিয় শ্রোতা বন্ধু, আমি ইসমাত, স্বাগত জানাই আপনাদের আমার অনুষ্ঠান অল্প সল্প গল্প এ। শুভেচ্ছা নিন।
আমারা সচরাচর যদি কাউকে জিগ্যেস করি, দিনকাল কেমন চলছে? কেউ বলে খুব ভালো, আবার কেউ বা বলে – ঐ… থোড় বড়ি খাড়া – খাড়া বড়ি থোড়, চলছে একরকম। অর্থাৎ, একঘেয়ে জীবন। তবে এর মাঝে যে নতুন ঘটনা ঘটে না তা তো নয়। হতে পারে ভালো, বা মন্দ। আবার কারো কারো জীবনে বিশেষ ঘটনাও ঘটে কোন রকম পূর্বাভাষ ছাড়াই। যা কি না মানুষের জীবনকে আমুল বদলে দেয়। আজ আমি আপনাদের তেমনি এক বিশেষ গল্প বলবো, যা খুব কম মানুষের জীবনে ঘটে ————–
সূর্যটা ঠিক মাথার উপরে। প্রচণ্ড তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে, তবুও সালেহা ঠায় বসে আছে প্রায় ঘণ্টা দুই হল। আজ বড় ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা না করে ও যাবে না। আগের বার যখন এসেছিল, তখন ম্যানেজার সাহেব, যে কিনা ওর পাড়াতেই থাকে, বলেছিল, আজ আসলে বড় ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করিয়ে দেবে। উনি হয়তো ওর মা’র চিকিৎসা আর ওর একটা কোন কাজের ব্যবস্থা উনি করে দিতে পারবেন। এই ডাক্তার সাহেবের অনেক সুনাম আছে। তাঁর নাকি দয়ার শরীর। অসহায়, গরীব দুঃখী মানুষদের উনি অনেক সাহায্য করেন। সালেহা ভাবছে, মা’কে ওষুধ না খাওয়ালেই নয়। মা যে খুব কষ্ট পাচ্ছে, পেটে অনেকদিনের ঘা। সারাদিন কাঁটা গরুর মতো এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করে আর শুধু আল্লাহকে ডাকে মরণ চেয়ে। ওর পাড়ার এক ডাক্তার বলে দিয়েছে বড় হাসপাতালে নিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে। হয়তো পেট কাটতে হবে। নাহলে নাকি এই অসুখ ভালো হবে না। কিন্তু, সে তো অনেক টাকার ব্যাপার। কোথায় পাবে ও এত টাকা? একবেলার খাওয়া জোটাতেই কত কষ্ট। কপালটা পোড়া, তাই স্বামী ছেড়ে গেছে ও যখন অন্তঃসত্ত্বা তখন। ওর মেয়ের বয়স এখন ৬ মাস। ওর বুকের দুধে কুলিয়ে যায় বলে রক্ষা, তা না হলে, এইটুকু বাচ্চার খাবারও জোগাড় করতে পারতো না। এতটুকু বাচ্চা নিয়ে ও এখন কোথায় যাবে, কি কাজ করবে ও? কেউ তো বাচ্চা সমেত কাজেও রাখে না।
অগত্যা মেয়েকে অসুস্থ মা’র কাছে রেখে পাড়ার দুটি অবস্থাপন্ন বাড়িতে এটা সেটা কাজ করে দেয়। তাতে কোনরকমে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটে, আর জোটে সামান্য কিছু টাকা। তাতে কুলিয়ে উঠতে পারে না। ভাইরা খোঁজও নেয় না। যে যার সংসারের স্বার্থে অন্য পাড়ায় উঠে গেছে, যাতে ওদের দেখতে না হয়। আর বাবা তো মারা গেছে অনেক আগে। এখন বাঁচতে আর বাঁচাতে হলে ওর একটি কাজের যে খুব দরকার —— তাই সকাল হতেই সালেহা হাতের কাজ সেরে একটুখানি পান্তা ভাত, লবণ আর শুকনো মরিচ ডোলে নিজে খেল। মার জন্য একটু মুড়ি ভিজেয়ে রাখল। তারপর ছেলেকে দুধ খাইয়ে মায়ের পাশে শুইয়ে রেখে ও বেরিয়ে পড়লো অনেকটা পথ যেতে হবে ~~~~~~~~~
মাইল তিনেক পথ হেঁটে এসেছে, সেই থেকে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে, ঢোকটাও আর গেলা যাচ্ছে না। মুখ তেঁতো হয়ে আছে। কখন যে আসবেন ডাক্তার সাহেব? শুনেছে আজ আসতে দেরি হবে। ও বসে বসে ভাবছে, কিছু কিছু মানুষ যে বড় অমানুষ, সেটা ওর স্বামী চলে যাবার পর থেকে খুব তিক্ত ভাবে উপলব্ধি করছে প্রতিনিয়ত। কেউ কেউ আবার বিয়ের কথা বললে, ও মুখ ঝামটা মেরে দু’কথা শুনিয়ে দেয় ~~~ ওর বুকটা খুব টন টন করছে, কতক্ষণ খায় না ওর মেয়েটা, হয়তো খুব কাঁদছে এখন ~~~
চোখ বুজে এসব ভাবনায় ডুবে ছিল সালেহা। হঠাৎ গাড়ির শব্দে চোখ খুলে দেখল একটি বড় গাড়ি থেকে ম্যানেজার সাহেব কে নামতে আর তার পরে যিনি নামলেম তিনিই যে ডাক্তার সাহেব সেটি ও বুঝতে পারলো।
মিনিট বিশেক পর ছালেহা দাঁড়িয়ে আছে ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে। মাঝ বয়সী ডাক্তার সাহেব কাগজ পত্র নিয়ে ব্যাস্ত। মুখ না তুলেই বললেন, “বস”। কিন্তু ও বসল না, দাঁড়িয়েই রইলো। খানিক পর মুখ তুলতেই ডাক্তার সাহেবের চোখ আটকে গেল মেয়েটির ওপর। আধ ময়লা সাড়ি পরনে একটি ভর-ভরন্ত যুবতী তাঁর সামনে। মেয়েটি তাকিয়ে আছে তাঁরই দিকে উৎসুক চোখে, ঘাড়টা একটু কাত করে দেখছে তাঁকে। তখনই মনে পড়লো, ম্যানেজার বলেছিল মেয়েটির সাহায্য দরকার। উনি তখন চশমা খুলে রেখে নিজের
চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে বসে জানতে চাইলেন, “নাম কি? স্বামী নেই নিশ্চয়ই। বাচ্চা আছে”? ~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সালেহা নিজের নাম বলে বলল, “জি, একটা মেয়ে আছে আমার” ডাক্তার সাহেব জানতে চাইনেল, “বাচ্চার বয়স কত?” “৬ মাস” বলে সালেহা আঁচল টেনে ভালো করে শরীরটা ঢাকল। বুকের কাছে শাড়িটা ভিজে গেছে। মুহূর্তে অনেক কিছু খেলে গেল ডাক্তারের সাহেবের মাথায় ~~ কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর, একটুকরো কাগজে খস খস করে কিছু লিখে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “কাল দেখা হবে, আজ এসো”। সালেহা হাত বাড়িয়ে কাগজটি নিয়ে দেখল ওতে একটি ঠিকানা লেখা, আর নীচে লেখা – সন্ধ্যা সাতটায় আসবে।
ও কি বুঝল ঠিক বোঝা গেল না, একবার শুধু বলতে চেষ্টা করলো, “আমার মা’র জন্যে… ততোক্ষণে ডাক্তার ওর পাস দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেছেন চেম্বার থেকে। অসহায় অবস্থায় মন খারাপ করে সালেহা বেরিয়ে এল ঘর থেকেো। আজও কিছু হল না… ভেবে চোখে পানি এসে গেল ওর। ফিরতি পথে ও ভাবছে… উনি অমন করে কেন দেখছিলেন ওকে? কি দেখছিলেন? ও জানে অনেক পুরুষ মানুষ ওকে একবার দেখলে আবার ফিরে ফিরে দেখে। মাঝে মাঝে ঘেন্না হয় কোন কোন পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি দেখলে। কিন্তু ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~ ~~কই, ডাক্তার সাহেবের চাহনিতে গা ঘিন ঘিন করলো না তো! কি ছিল ঐ চাহনিতে? কি যেন কি ছিল, ও বুঝতে পারছে না। উনি কোথায় যেতে বললেন ওকে? ও কি কাজ পাবে ঐ ঠিকানায় গেলে? ~~ এমনই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে পা চালাল জোরে ~~~~~~~
কতক্ষণ না খেয়ে আছে মেয়েটা, গায়ের কাপড়টা আরও ভিজে গেছে। মা’র মন ছুটছে, ভাবছে আর কতদূর ~~ পথ যে শেষ হয় না ~~
আর কতদূর ~~~~~~~~~~
পরদিন আশা নিরাশার দোলায় দুলে সময়ের অনেক আগেই সালেহা পৌঁছে গেল ঠিকানা মতো। এসে বুঝল, এটি ডাক্তার সাহেবের বাড়ি, তিনি বসবার ঘরেই বসে বসে বই পড়ছিলেন। ওকে দেখে বললেন “এস, ভিতরে যাই”, বলে হল রুম পেরিয়ে আগে আগে হাটতে লাগ্লেন, আর পিছনে সালেহার বেশ ভয় করছে, উনি ভিতরে কেন নিয়ে যাচ্ছেন ওকে কে যানে? যদি কিছু হয়…? ভয়ে ভয়ে অন্য ঘরটিতে এসে দেখল, ওর মেয়ের চেয়ে আরও ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে চারপাশ দিয়ে ঘেরা ছোট্ট সুন্দর একটি বিছানায়। ডাক্তার সাহেব বললেন, “একে দেখো। একে আমি হাসপাতাল থেকে এনেছি। ওর কেউ নেই আমি ছাড়া”। চমকে তাকাল সালেহা ডাক্তার সাহেবের দিকে, তারপর বাচ্চাটির দিকে। ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ডাক্তার বলেন, “ওর আগে ওর বাপ মায়ের আরও দু’টি মেয়ে হয়েছে বলে ওর বাবা ওর মাকে বলে দিয়েছিল, এবারেও যদি মেয়ে হয় তাহলে ওর মাকে সে তালাক দেবে। কারণ ওর বাপের ছেলে দরকার, বুঝলে? আর এদিকে তালাকের ভয়ে ওর অসহায়, গরীব মা ওর নাড়ি কেটে ফেলে গেছে ওকে হাসপাতালে চিরজীবনের জন্যে। আর ওর মূর্খ বাপটাকে জানানো হয়েছে যে একটি মরা বাচ্চা হয়েছে ওদের”। সালেহা হতবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে ডাক্তারের কথা শুনছে। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠেছে কষ্টে, ভাবছে, এ কোন পাষাণী মা??? কি করে পারল বুকের মানিককে~ এভাবে ফেলে যেতে! ডাক্তার বললেন, “কিন্তু ওর যে এখন একজন মা’র খুব প্রয়োজন। এমন একজন মা, যে ওকে ভালবেসে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মায়ের আদর দিয়ে নিজের সন্তানের মত করে বাঁচাবে। জান, কাল তোমাকে দেখে আমার কেন যেন মনে হল, তুমিই ওর মা হতে পারবে! তাই আসতে বলেছিলাম। হবে তুমি ওর মা? আমি, আমি জানি, আমি জানি যে তোমার নিজের ছোট্ট একটি বাচ্চা আছে, তবুও একটু ভেবে দেখ। তোমাদের সব দায়িত্ব আমি নেব”। ভেবে দেখ, বলে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ~~ সালেহার মা সত্ত্বা কাতর তখন, এদিকে ডাক্তার সাহেবের কথাটি কানে বাজছে যে, উনি ওদের সব দায়িত্ব নেবেন বলেছেন। ঠিক বুজতে পারছে না ওর কি করা উচিত। মেয়ের কথা, মা’র কথা মনে হচ্ছে। এদিকে এই বাচ্চাটির জন্যও খুব মায়া হচ্ছে। মন পুড়ছে এই কয়েক মুহূর্তেই। ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একটু পরে ডাক্তার ফিরে এসে বললেন, “তুমি ভাবতে সময় নাও কয়েকদিন, তারপর নাহয় জানিয়ে দিও। আমাকে অন্য কাউকে খুঁজতে হবে। আয়া তো মা হয় না। ওর জন্য মা’ খুঁজতে হবে”। সালেহা তখন দৃঢ় কণ্ঠে বলল… “জি ডাক্তার সাহেব, আমার সময় লাগবে না, আজ থেকে ~~ আমি ওর মা। আমার মেয়ে বাঁচলে ও বাঁচবে। আমি হব ওর মা। আমি একটু কোলে নেই ওকে? এই বলে ঘুমন্ত বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে বুকের সাথে পরম আদরে চেপে ধরল সালেহা। গালের সাথে গাল লাগিয়ে বলল, “এখন থেকে আমি তোর মা সোনা। আমার বুকে থাকবি তুই আমার আরেক মেয়ে হয়ে”। ঐ মুহূর্তে ও ভুলে গেল বাকী সব কিছু, শুধু ওর নিজের মেয়েটির কথা মনে হতে থাকল। বিড় বিড় করে বলল, “আজ থেকে আমার দুই মেয়ে”। তারপর কি মনে করে একটু আড়াল খুঁজে ওকে খাওয়াতে বসলো। ডাক্তার সাহেবকে জিগ্যেসও করল না ~~ দুচোখ ঝাপসা হয়ে গেল কষ্ট আর তৃপ্তির বোবা কান্নার জলে। ডাক্তার দেখলেন সেই অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য~~ ভাবছেন, বাচ্চাটি হয়তো এই প্রথম মায়ের দুধ খাচ্ছে~~ উনি দরজাটি ভিড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। তাঁর চোখও যে ঝাপসা হয়ে গেছে তখন ~~~~~~ তাঁর কোন সন্তান হবে না বলে তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন একটি বাচ্চা দত্তক নিতে, কিন্তু তাঁর স্স্ত্রী রাজি হন নি কখনো। কিন্ত হাসপাতালে এই বাচ্চাটির কথা যখন উনি শুনলেন, তখন ওকে দেখে ঐ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী কোন এতীমখানায় না দিয়ে ওকে বাড়ি নিয়ে আসেন ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সেই থেকে তাঁদের স্বামি-স্ত্রীর মধ্যে বেশ ঝামেলা চলছে। তাঁর স্ত্রি ভুলেও বাচ্চাটিকে দেখেন না। উনি একটি আয়া রেখেছেন ওর দেখা শোনার জন্যে। কিন্তু সালেহাকে পেয়ে উনি যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। বুঝতে পারলেন, এ নিয়ে তাঁর দাম্পত্য জীবনে অশান্তি আরও বাড়বে, কিন্তু তবুও যেন অনেক বড় ভার বুক থেকে নেমে গেল। কালই সালেহা, ওর বাচ্চা আর মা’র এখানে থাকার ব্যাবস্থা করতে হবে। এই মেয়ের ঋণ তো উনি শোধ করতে পারবেন না, তবুও যতটুকু পারেন, উনি করবেন ওদের জন্য ~~~~ এদিকে সালেহা ডাক্তার সাহেব কে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখল আর ভাবল ~~ কে উনি? উনি কি শুধুই একজন মানুষ, নাকি মানুষের রূপে কোন ফেরেশতা!
এখানে কে মানুষ আর কে ফেরেশতা ~~ ডাক্তার, নাকি সালেহা? আমি জানি না। তবে এই দুজন মানুষ এই অভাগা বাচ্চাটির ভাগ্য বদলে দিল। নাহলে ওকেও অনেক হতভাগা বাচ্চার মত এতীম হিসেবে বড় হতে হত কোন এতীমখানায়। যদিও সে জন্য ডাক্তার সাহেবকে অনেক বড় মুল্য দিতে হয়েছে ~ তবে এটাই তো নিয়ম জগতের ~ কিছু পেতে হলে কিছু যে ছাড়তেই হয়। উনি পেয়েছেন, সীমাহীন শান্তি, ওকে বাবার পরিচয় দিতে পেরে। এ সমাজে এমন অনেক পুরুষ আছে যারা সালেহার স্বামি আর শিশুটির কাপুরুস, নিষ্ঠুর জন্মদাতাটির মত, আবার এমন কেউ কেউ আছেন এই ডাক্তার সাহেবের মত। আর এমন মাও আছে সালেহার মত।
প্রিয় শ্রোতা, আমি কৃতজ্ঞ ~ আপনারা অনেক ব্যাস্ততার মাঝেও সময় করে আমার গল্প শোনেন বলে। আপনাদের উৎসাহ, অনুপ্রেরনা, আর ভালোবাসা আমাকে আবার নিয়ে আসে আপনাদের কাছে। এরই মধ্যে আমার দুজন বন্ধু আমাকে তাদের গল্প দিয়েছেন আপনাদের শোনাতে। শিঘ্রি সেগুলো শোনাবো। আর আপনার গল্প শোনাতে চাইলে আমাকে লিখুন @ theradiometromail.com এ। আর শুনতে থাকুন Radio Metro Mail – বিশ্বব্যাপী আমরা J ফিরছি পরের সপ্তাহে ~~ খুব ভালো থাকুন ~~~~~~~~~
#আমি_চিত্রাঙ্গদা
গল্প ৬ – ধুসর গোধূলি
– ইসমাত সুলতানা
আজ ঘুম ভাঙ্গতেই উত্তর দিকের জানালা দিয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে ধারার বেশ শীত করলো। ইচ্ছে হল আজ কলেজে না গিয়ে রোদে বসে থাকতে। আর সেই সব দিনের কথা ভাবতে যখন ও কলেজে পড়ত। হুম ভাবতে ইচ্ছে করছে কারণ আজ কাজলের বাড়িতে যাবে কলেজ শেষ করে। কাজল কাল রাতে ফোনে জানিয়েছে, সময় নেই বেশী হাতে তাই শিঘ্রি যেন ও তূর্যকে দেখে আসে। তাই ইচ্ছে হল না কলেজে যেতে। কিন্তু জরুরী ক্লাস আছে। তাই সময়মত বেরিয়ে পড়লো। কলেজ শেষ করে কলেজ থেকে বেরিয়ে ও একটা রিক্সায় উঠে পড়ল।
অনেক বছর পরে দেখা হবে আজ ওদের, কিন্তু ঠিক কত বছর তা হিসেব করতে ইচ্ছে করল না। এরপর আবার কবে দেখা হবে ও যানে না, পরের মাসেই তো ও চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে ওর পিএইচডি টা করতে। মনে পড়লো কত স্মৃতি ওদের একসাথে। ওরা ছিল কলেজ জীবনের বন্ধু। মনে পড়ল ওদের প্রথম যেদিন দেখা হল সেদিনের কথা
সেদিনও আর সব দিনের মতই সব বন্ধুরা মিলে কলেজের বট তলায় বসে আড্ডা দিচ্ছে যথারীতি। হঠাৎ একটি অপরিচিত ছেলে এসে ওর বন্ধু কাজল এর কাছে ম্যাচ চাইলো, ওদের দেখে মনে হল ওরা চেনে একে অপরকে। ওরা সবাই ছেলেটির দিকে তাকাল। দারুণ দেখতে ছেলেটি, মাথা ভরা ঘন কালো কোঁকড়া চুল এলোমেলো হয়ে কপালটাকে প্রায় ঢেকে রেখেছে। পরনে নীল রঙের জিনস আর সাদা শার্ট। বেশ উন্নাসিক একটা ভাব। কারো দিকে তেমন তাকাল না। কাজল ওকে ম্যাচটা দিলে ওর সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে চলে যাবার আগে হঠাৎই ধারা’র দিকে তাকাল। স্থির সে দৃষ্টি। বলল, “আপনি খুব সুন্দর?” ধারা ওর দিকে আগে থেকেই তাকিয়ে ছিল, তাই চোখাচোখি হয়ে গেল, কিন্তু কথাটা এতো আচমকা এলো যে, ও আর বাকি বন্ধুরা হা করে তাকিয়ে রইল ছেলেটির দিকে। ছোট্ট করে দায়সারা গোছের থ্যাংকস বলে চোখ সরিয়ে নিল ধারা। ছেলেটি কোনোরকম ভণিতা না করে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “Sorry, please don’t get me wrong, she is really beautiful” তারপর ধারা’র দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে সরি’ বলে চলে গেল। এবার সবাই কাজলের দিকে তাকাল চোখে প্রশ্ন নিয়ে। সবার আগে কল্লোল জিগ্যেসে করলো, “এই নায়কটা কে রে”? কাজল বলল, “ও তূর্য, আমার পাড়ারই ছেলে, আমার বন্ধু। ও অন্য কলেজে পড়ে। আজ এখানে আমার সাথেই এসেছে কারও সাথে দেখা করবে বলে, পলিটিকাল কিছু”। এদিকে ধারা তখন ভাবছে, কি ছেলেরে বাবা, এমন খোলাখুলি ভাবে নির্দ্বিধায় কি করে ওকে অমন করে বলে গেল! ওদিকে বন্ধুরা তখন ওকে যা নয় তাই বলে ক্ষ্যাপাতে শুরু করেছে, কল্লোল তো বলেই বসলো, “এই যে সুন্দরী, আরও সাড়ি পর, কতদিন মানা করেছি সাড়ি পরে আসবিনা ক্যাম্পাসে, আমারই মাথা খারাপ হয়ে যায় তোকে দেখলে, আর অন্যদের তো হবেই”। ধারা সেদিন কি মনে করে তাঁতের একটা সাড়ি পরেছিল। ও এমনিতেই দেখতে বেশ সুন্দর, গায়ের রঙ একটু চাপা হলেও বেশ মিষ্টি একটা চেহারা। বুদ্ধিদীপ্ত চঞ্চল এক জোড়া চোখ, সারাক্ষণ কথা বলে। ছিমছাম একহারা গড়ন। ঘন কালো চুল, কোমরের কাছে থেমে গেছে। বাঁ হাতের মণি বন্ধনীতে ছোট্ট কালো ডায়ালের ঘড়ি। ডান হাতটা ও সবসময় খালি রাখে। নিজেকে ছিম ছাম করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে, যেন সুনীলের উপন্যাসের নায়িকা। ওকে দেখলে যে কারোরই ভালো লাগে। আর সত্যি ওকে সাড়িতে খুব সুন্দর লাগছিলো দেখতে। এরপর কিছুক্ষণ এলে বেলে কথা বারতার পরে যে যার মতো ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরে গেছে সবাই। এর দিন কয়েক পরে হঠাৎ সেদিন রাত ১টার দিকে ওর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। সাধারণত এত রাতে কেউ ফোন করে না। ভ্রু কুঁচকে ও ফোনটা নিলো। নম্বরটা অপরিচিত দেখেও হ্যালো বলল এই ভেবে যে, হতে পারে কোন দরকারি ফোন। ওপাশ থেকে ছেলে কণ্ঠের জিজ্ঞাসা,
– কেমন আছো?
– কে বলছেন?
– আমি তূর্য
– কে তূর্য? আমি কি চিনি আপনাকে? মনে পড়ছে না তো?
– না, চেন না তুমি আমাকে, একবার শুধু দেখেছ।
ধারা তখনো কিছুই মনে করতে পারে নি, ও বলল,
– সরি, অচেনা কারো সাথে আমি কথা বলি না
– কি মুশকিল, কথা না বললে চেনা-জানা হবে কি করে?
– সরি, আমি আপনার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নই। আর শুনুন, এতো রাতে কোন ভদ্র ঘরের মেয়েকে ফোন করাটা যে খুব অশোভন, এটা আপনার যানা উচিত ছিল
– আচ্ছা, এতো উচিত-অনুচিত ভাবলে কি আর চলে?
– কিন্তু আমি কথা বলতে চাই না, বলে ফোন টা কেটে দিল ধারা। এর ঠিক দু মিনিটের মাথায় ফোনে মেসেজ এলো “সৃষ্টিকর্তা তোমাকে সুন্দর করে বানানোর সাথে সাথে অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠস্বর দিয়ে তোমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তুমি যদি ভাবো এই সুন্দর কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে আমার সময় নির্ধারণ করে দেবে, তাহলে তুমি অবিচার করছ” ধারা নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল। খেয়াল করলো যে, ছেলেটা নিঃসঙ্কোচে কথা বলার মতো লিখেছেও বেশ দ্বিধা হীনভাবে! এতো রাতে যে ফোন করেছে, সেটা যেন খুব স্বাভাবিক! পাত্তাই দিল না ওর দেয়া সামাজিক জ্ঞানের, নিয়ম নীতির। খানিক বাদে আরও একটা মেসেজ এলো, “খুব বেশী ইচ্ছে করছে জলতরঙ্গের মতো ঐ অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠস্বর আরও একবার শুনতে, কিন্তু আমি জানি তুমি এখন আর ফোন ধরবে না। কি করি বলতো?” ধারা কেন যেন বিরক্ত হতে পারল না। বরং মজাই পেল। কিন্তু সেদিন এসবকে গুরুত্ব না দিয়ে ও ঘুমিয়ে পড়লো। পরদিন সকালে ঘুম ভাংতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল ওর তূর্যকে, আর সেদিন কলেজে দেখা হবার কথাও মনে পড়ে গেল। খুব হাসি পেল ওর। অদ্ভুত ভাবে কথা বলে ছেলেটা, অথচ উগ্র মনে হয় নি, সেদিনও না, কাল রাতেও না।
শুরুটা এমনই ছিল। তার কয়েকদিন পরে কাজলের কাছ থেকে ধারা জানতে পারলো যে তূর্য ওকে প্রথমবার দেখেই ভীষণ পছন্দ করে ফেলে। তাই ওর সাথে কথা বলবে বলে কাজলের কাছে ওর ফোন নম্বর চেয়েছিল কিন্তু কাজল দেয় নি। তখন বাধ্য হয়ে কাজলের ফোন থেকে নম্বরটা চুরি করেই ফোন করেছিলো সেদিন রাতে। আর ফোনে ধারার কণ্ঠ শুনে শেষ রক্ষা আর হল না, এবারে পুরোপুরিই গেল। ধারা’কে ছাড়া ওর আর চলবে না। যেভাবেই হোক ধারা’কে ওর চাই ই চাই। তাই এরপর, ঘন ঘন ওর কলেজে আসতে শুরু করে শুধুমাত্র ধারাকে দেখবে বলে। কয়েকদিনেই ধারা’র বন্ধুদের সাথে ওর বন্ধুত্ব্ব হয়ে গেল। কেবল কল্লোল ওকে সহ্য করতে পারে না। তূর্য এলেই কল্লোল উঠে চলে যায়। কিন্তু ধারা ওকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না। এতে তূর্য আরও মরিয়া হয়ে ধারা’কে চিঠি লিখতে শুরু করে একের পর এক। সেসব প্রেমপত্র পড়ে ধারা কখনো হাসে, কখনো বিরক্ত হয়, আবার অসহায়ও লাগে ওর। ও কিছুতেই তূর্যকে বোঝাতে পারে না যে, ও ওকে ভালবাসে না, তূর্য কেবল ওর বন্ধু আর সবার মত, এর বেশী কিচ্ছু না। অনেকবার মানা করেছে এভাবে চিঠি না লিখতে, ওকে নিয়ে ভালোবাসার স্বপ্ন না দেখতে, কিন্তু কে শোনে কার কথা! তূর্য থামে না। ধারা যে তখন বিভোর ওর প্রথম ভালোবাসার মানুষ রোমেল’কে নিয়ে। ওর ধ্যান, জ্ঞান, ওর আকুলতা, ব্যাকুলতা, ওর আনন্দ সবই তাকে ঘিরে। তাই ওর প্রতি অন্য ছেলেদের আগ্রহে ওর কোন আগ্রহই ছিল না।
ওদিকে তূর্য হাল ছাড়ে না মোটেও। শত উপেক্ষা অগ্রাহ্য করে ক্লান্তিহীন ভাবে। মাঝে মাঝেই ফোন করে আর বলে, “পৃথিবীতে আমার চাইতে বেশী কেউ তোমাকে ভালবাসতে পারবে না, সেটা কেন বোঝ না তুমি”? আমি ভালো নেই ধারা। আমার ভালো থাকা, না থাকা সব যে তুমি। এই যে দেখ না, আমি লেখাপড়ায় মন দিতে পারছি না, তুমি আমাকে ভালোবাসো না বলে। আমি মরে যাবো তোমাকে না পেলে— এমনই আরও কত কত কথা লিখে আর বলে।
…… ধারা এসব শোনে, আর খুব অসহায় হয়ে ভাবে, ও কি করবে? ও তো তূর্য কে বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারবে না! কি করে তূর্য’র মন থেকে এই ভালোলাগাকে সরাবে, কিছুই বুঝতে পারে না? অনেক চেষ্টা করেও তূর্যকে বোঝাতে পারে না। ওর উপেক্ষায় তূর্যর মন খারাপ আরও বেড়ে যায়। তূর্য কখনো রেগে যায়, কখনো বা চোখের পানি লুকিয়ে চলে যায় ওর সামনে থেকে। এভাবেই সময় যায় আর ধীরে ধীরে তূর্য’র মনে অভিমান জমা হতে থাকে। সেই পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে তূর্য শেষ পর্যন্ত চলে গেল ওদের শহর ছেড়ে অন্য শহরে। ভর্তি হল গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাবার আগে বলে গেল, “আমি সারাজীবন তোমাকেই ভালোবেসে যাবো, কিন্তু তোমার সামনে আর কোনদিন আসবো না। তুমি থাকো তোমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে”। ধারা ভাবে, তূর্যটা খুব ছেলে মানুষ!
অভিমানী তূর্য পড়তে গেল ঠিকই কিন্তু পড়ে গেল অসৎ সংসর্গে। কিছু মাদকাসক্ত ছেলে ওকেও মাদকে আসক্ত করে তুলল। তূর্য চাইলো ধারা’কে না পাওয়ার কষ্ট ভুলে থাকতে, তাই ইচ্ছে করে এই সর্বনাশা নেশায় মত্ত হয়ে উঠলো। এদিকে পরের বছর ধারা ভর্তি হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাঝে মাঝে ওর কানে তূর্য’র মাদকাসক্তির খবর আসে, খুব মন খারাপ হয়, ও কষ্টও পায় অনেক। ছুটিতে ওরা যার যার মতো বাড়িতে আসে। আর কোনদিন ওর সামনে আসবে না বলেও তূর্য একদিন আসে ধারাকে দেখতে। বলে, না এসে পারল না। ওকে একটিবার দেখার জন্য ও ভোরের ট্রেন ধরে ছুটে এসেছে। ধারা ওকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বলে। তূর্য বলে, “ফিরবো যদি তুমি আসো আমার কাছে। আর যদি না আসো তাহলে ফিরতে বোলো না। তোমাকে ভুলতে তো পারি না, কিন্তু ড্রাগ নিলে অন্য জগতে যেতে পারি, কিন্তু তবু তো পারি না ভুলতে। যাহোক, তুমি ভালো থেকো” বলে অপলক তাকিয়ে থাকে তূর্য ধারা’র দিকে। তারপর একসময় চলে যায়। এভাবেই একটু একটু করে তূর্য চলে গেল সব রকম নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পড়াশোনা টা আর হল না। ভাবনায় ছেদ পড়লো, ও কাজলের বাড়ি পৌঁছে গেছে। কাজল এখনও ফেরে নি অফিস থেকে। ওর স্ত্রীর সাথে দুই একটা কথা বলে তারপর তূর্য যে ঘরে আছে, সে ঘরটির সামনে গিয়ে একটু দ্বিধা হল ঢুকতে, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে দরজায় আলতো করে টোকা দিতেই ভেতর থেকে একটি মেয়ে কণ্ঠ বলল, “ভেতরে আসুন” দরজা খুলে ধীর পায়ে ঘরের ভেতরে ঢুকল ধারা। তারপর যা দেখল তা নিজের চোখে না দেখলে ওর বিশ্বাস হতো না ……………
বিছানায় শুয়ে আছে তূর্য, ধারা’র পা থেমে গেল, এ কাকে দেখছে ও! একি চেহারা হয়েছে তূর্য‘র! ওর মনে তূর্যর সেই কলেজ জীবনের চেহারার সাথে এই মানুষটার কোন মিল নেই। খুব রোগা হয়ে গেছে, একেবারে যেন বিছানার সাথে মিশে আছে মলিন, শীর্ণ শরীরটা। চুলগুলো এলোমেলো। মুখে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি। ধারা’কে দেখল কি দেখল না বোঝা গেলো না, ক্লান্ত চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। কোন অভিব্যক্তি নেই সে চোখে। প্রচণ্ড ধাক্কা খেল ও। ধারা’র কোন খেয়াল ছিল না যে ঘরে আরও কেউ আছে। ও আস্তে বিছানার পাশে গিয়ে তূর্য’র কপালে হাত রেখে বলল, “তূর্য, কেমন আছো?” তূর্য তাকাল না, ও বলল, “আমি ধারা তূর্য” ঘরে যে অন্য মেয়েটি ছিল, সে চমকে তাকাল ধারা’র দিকে, বলল, “আপনি ধারা? কত খুঁজেছি আপনাকে, একবার দেখতে চেয়েছি। একবার অনুরোধ করতে চেয়েছি, ওকে একটিবারের জন্য দেখে যেতে, কিন্তু তূর্য আমাকে তা করতে দেয় নি। আজ আপনি এমন সময় এলেন, যখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। ও চলে যাচ্ছে আমাকে একা ফেলে”— এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মেয়েটা হাতের কাজ রেখে তূর্য’র কাছে এলো। ওর বুকের উপর ঝুঁকে পরম আদরে, মায়া ভরা কণ্ঠে বলল, “এদিকে তাকাও লক্ষ্মীটি, দেখো কে এসেছে তোমাকে দেখতে। দেখ, তোমার ধারা! এই যে দেখো, তোমাকে স্পর্শ করে আছে” বলে ধারা’র হাতটি আলতো করে ধরে তূর্য’র বুকের উপরে রাখল, বলল, “বুঝতে পারছ?”… ধারা হাতটা সরিয়ে নিল না। ধারা তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে, খুব সাদামাটা দেখতে, কিন্তু মায়া ভরা চেহারা, আচরণে মাতৃত্বের ছোঁয়া। মেয়েটি এবার নিজেই নিজের পরিচয় দিল, “আমি মিলি, ওর স্ত্রী। হ্যাঁ আমি ওকে বিয়ে করেছি, ও কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে চায় নি। ও বলত, “আমার বিয়ে হলে শুধু আমার ধারা’র সাথেই হত, কিন্তু ধারা তো আমাকে ভালোই বাসল না। তাই বিয়েও আর করা হল না”, আমি শুনতাম ওর কথা, আর আমার চোখের পানি লুকাতাম কাজের ওজুহাতে, কারণ আমি ওর সেবা করতে করতে ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ও যখন অনেক বেশী অসুস্থ হয়ে গেল, সেন্স কমে গেলো, তখন আমি একরকম জোর করেই ওকে বিয়েতে রাজি করালাম। ওর তখন কিছু বলার, বা করার ক্ষমতা ছিল না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতো। ওর কাছে পাকাপাকিভাবে থাকতে সামাজিক এই সম্পর্কটা দরকার ছিল। ও বুঝতে পেরেছে কি না আমি আজও জানি না। কয়েক বছর আগে ওকে যখন এখানকার এই পুনুরবাসন কেন্দ্রে আনা হয়েছিল চিকিৎসার জন্য, তখন আমি ওর নার্স ছিলাম। তখন ওর অবস্থা এমন ছিল না। তখনও ব্রেইন কাজ করত। তাই ওর যখন একটু ভালো লাগত, তখন আমাকে আপনার কথা বলতো। বলতো, “সিস্টার, শুনবেন আমার ধারা’র কথা?” আমিও খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতাম। এভাবেই একটু একটু করে সবকিছু বলেছিল। আর এও বলেছিল যে, এ জীবনে ও আর কাউকে ভালবাসতে পারবে না। আমি বুঝেছিলাম ও আমাকে কোনদিনই ভালবাসবে না, তবুও আমি নিজেকে আটকাতে পারি নি। ওর কাছ থেকে কোন প্রতিদান আশা না করেই আমি ওকে ভালবেসেছি। জানেন, এই পৃথিবীতে ও একমাত্র আপনাকেই ভালবেসেছে, হয়তো আজও বাসে ওর অবচেতন মনে”। মেয়েটা বলছে আর ধারা চুপচাপ শুনছে। এর মাঝে কাজলের স্ত্রী ওদের চা দিয়ে গেল। কিন্তু সেদিকে কারো খেয়াল নেই। মিলি বলছে, “আপনি তো চিনতেন ওদের সবাইকে, ওর বড় ভাই ওর ড্রাগ, এলকোহল ছাড়াতে না পেরে ওর সাথে সম্পর্ক রাখে নি। বাবা, মা বেঁচে নেই। বোনেরা মাঝে মাঝে দেখতে আসে। আর আসে দুই একজন বন্ধু। ওর আপন বলতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি ঐ পুনুরবাসন কেন্দ্রেই চাকরি করি, তাই কর্তৃপক্ষের বিশেষ বিবেচনায় এখানে ভালো চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করেছি আমার সাধ্য মত। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। সত্যি আপনাকে দেখার আমার খুব ইচ্ছে ছিল, ভাবি নি এভাবে দেখা হয়ে যাবে। ওর তো সময় ফুরিয়ে এসেছে, তাই আমি খুব চেয়েছিলাম যাবার আগে একবার যদি আপনাকে ও দেখতে পেত। সেই তো আপনি এলেন, কিন্তু বড় দেরী হয়ে গেলো। ও তো বুঝতেও পারছে না আপনি এসেছেন”। একটানা এতগুলো কথা বলে মিলি থামল। কথা বলতে বলতে ওর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। ধারা জানত তূর্য ভীষণভাবে মাদকাসক্ত হয়ে গেছে সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে। কিন্তু এই পর্যায়ে চলে এসেছে, সেটা ভাবতেও পারে নি। জিগ্যেস করলো, “ডাক্তার কি বলেছেন? কোন আশা নেই আর?” মিলি এবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ধারা আর কিছু বলল না শুধু ওর কাছে এসে ওর পিঠের উপর একটা হাত রেখে বলল, “কেঁদো না, তুমি তো অনেক সাহসী মেয়ে, ধৈর্য ধর”। মিলি কাঁদছে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ধারার বুক থেকে। “আমি একটু পরে আসছি”, বলে ঘর থেকে পালিয়ে এসে অন্যদিকের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো নিজেকে সামলাতে।
বাইরে তখন গোধূলি বেলা। পশ্চিমাকাশে সোনা রঙের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিন এসময়টা ধারা খুব উপভোগ করে, ওর প্রিয় সময়। কিন্তু আজ বিষাদে মন ছেয়ে গেছে। তূর্যকে এমন করুন অবস্থায় দেখবে কোনদিন ভাবে নি। ড্রাগ আর অ্যালকোহল ওকে জীবনের শেষ সীমায় টেনে নিয়ে চলেছে। স্ট্রোক করেছে একবার। সিরিয়াস ড্যামেজ হয়েছে ব্রেইন এর। হার্ট এর অবস্থা ভালো না। খুব দুর্বল। অ্যালকোহলের কারণে লিভার সিরোসিস হয়ে খুব খারাপ পর্যায়ে এখন। ডাক্তার ছুটি দিয়ে দিয়েছে। ডাক্তারি চিকিৎসায় তেমন কিছু করার নেই আর। এখন শুধু দিন গোনার পালা। ধারা ভাবছে, ভাগ্যের কি পরিহাস, যার জন্যে আজ তূর্য নিজেকে এভাবে শেষ করে দিল, সেই ধারা’কেই আজ আর চিনতে পারল না। চোখে শূন্য দৃষ্টি। চোখের সেই দ্যুতি কোথায় হারিয়ে গেল! সেই নির্ভীক, দ্বিধাহীন, স্পষ্ট কথা বলা ছেলেটি কোথায় এখন?
সূর্য ডুবে গেছে। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে আছে ধারা’র মনে নেই, ও যেন কোন ঘোরের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। আজ আবারও নিজেকে খুব অসহায় মনে হোল ওর। কেন এমন ভালোবাসা সৃষ্টি হয় কারো মনে, যা কেবল কষ্টই দেয়। মানুষ যা চায় তা কয়জন পায়? কোন কোন মানুষ এতটা দুর্বল কেন হয় যে, ভালবাসতে না পেরে এভাবে নিজেকে একটু একটু করে শেষ করে দেয়! কি করে তূর্য এত অত্যাচার করেছে নিজের উপরে! এত অভিমান! তবে কি এর জন্যে ও দায়ী? কিন্তু তাই বা কেন? ও কি করে তূর্যকে ভালবাসত! ওর ভালোবাসার মানুষ তো ছিল অন্য একজন! ~~~ প্রশ্নগুলো সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে ওর মনে। ধারা নিজেও যানে ভালোবাসার মানুষকে না পাবার কষ্ট কতটা অসহনীয়। তবুও ও মেনে নিয়েছে ডেস্টিনিকে। কিন্তু তূর্য কেন মানতে পারল না? নাকি এটাই নির্ধারিত ছিল ওর জীবনে? কোনটা ঠিক? নিজের সৃষ্টির এমন ডেস্টিনি কি করে লিখ তুমি খোদা?!
ও আর ফিরে যেতে পারলো না ও ঘরে। কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে এল। হাঁটছে ফুটপাথ ধরে। মনে মনে বলল, তোমাকে ভালোবাসি তূর্য, বন্ধু আমার, তবে আমার মত করে। যেখানে থাক, ভালো থেকো, আর পার তো আমাকে ক্ষমা কোরো। ঝাপসা চোখে পথ দেখতে অসুবিধা হচ্ছে কিন্তু সেদিকে ওর খেয়াল নেই। ও হাঁটছে আর ভাবছে কি নিষ্ঠুর ডেস্টিনি!!!
স্রোতা বন্ধু আমার, আমরা সবাই চলছি যার যার নির্ধারিত পথে। সবকিছুই আগে থেকে ঠিক করা থাকলেও আমাদের করমের ফল তো আমাদেরই ভোগ করতে হয়। তাই এমন কিছু করব না, যাতে জীবনের সময় এভাবে অসময়ে শেষ হয়ে যায়। সব পেয়েছির নাম জীবন হতে পারে না। সে শুধু হয় কল্প কাহিনীতে। যতটুকু পাই তাই নিয়েই ভালো থাকার নাম জিতে যাওয়া। নয়তো হার নিশ্চিত। সবাই ভালো থাকুন। লিখতে চাইলে আমাকে লিখুন @theradiometromail.com এ। আর সময় করে শুনতে থাকুন Radio Merto Mail – বিশ্বব্যাপী আমরা।
জানুয়ারি ১৬, ২০১৭
#আমিচিত্রাঙ্গদা
গল্প ৫ – নিষ্ঠুর নির্ণয়
– ইসমাত সুলতানা
আমার প্রিয় শ্রোতা বন্ধু, শুভেচ্ছা নিন। আমি ইসমাত, আমার অনুষ্ঠান “অল্প স্বল্প গল্প” নিয়ে চলে এলাম। নিশ্চল ভালো আছেন সবাই? ভালো থাকতে সুন্দর থাকতে আমরা কম বেশী সবাই চাই। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র, এ কথা সবাই বলে। কথাটি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সত্যি। কিন্তু অসুন্দরের অপ্রাপ্তিও কিছু কম নয়। আজ সেই সুন্দর অসুন্দরের কথা বলবো। চলুন আজ একটি বিয়ে বাড়িতে যাই। আজকের গল্পটি ওখানে বসেই বলি। কারণ যাকে নিয়ে আজকের গল্প সে ওখানেই আছে।
শুনতে পাচ্ছেন? সানাই বাজছে, আজ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান।
বেশ আনন্দঘন, উৎসব মুখর পরিবেশ। মেয়েরা সবাই সবুজ রঙের তাঁতের সাড়ি পরেছে, আর সেজেছেও খুব সুন্দর করে। কম বয়সী খুব ভালো লাগছে কম বয়সী মেয়েদের উচ্ছ্বাস দেখতে। ছেলেরা পরেছে মেরুন রঙের পাঞ্জাবী। বেশ সুখী সুখী মুখ সবার। বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই তো দারুণ সুখের, ভালো লাগার অনন্য সব মুহূর্ত! আমি এখানে খুব একটা পরিচিত নই। কনের খালার বান্ধবী আমি। সেই সূত্রে এই অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছি।
এইসব সুখী, উৎফুল্ল মুখের ভিড়ে একটি মেয়ে আমার মনোযোগ কেড়ে নিল। মেয়েটি সবার চাইতে আলাদা! আমার বান্ধবীটি সেই মেয়েটিকেই আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে দেখা শোনা করতে বলে ও অন্যদিকে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি ভালো করে পরিচিত হতেই জানতে চাইলাম…….”নাম কি তোমার?” মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে একটু যেন দেখল আমাকে, তারপর বলল, “আমি শাঁওলী”। বলার ভঙ্গীটি দারুণ স্মার্ট! মেয়েরা সাধারণত প্রথম পরিচয়ে এমনভাবে বলে না। আমার বেশ লাগলো। হেসে বললাম, “বাহ! খুব সুন্দর নাম, আর আমার খুব পছন্দেরও”।
আমার মুখে নামের প্রশংসা শুনে নামের মতই মিষ্টি করে হাসল, তবে নিঃশব্দে।
আজ এখানে যার গায়ে হলুদ হচ্ছে, এই মেয়েটি তার বড় বোন। ও আর পাঁচটি মেয়ের মত তথাকথিত সুন্দরী নয়। গায়ের রং বেশ চাপা। কমনীয়তাও তেমন নেই। কিন্তু একটা চটক আছে মেয়েটির চাল চলনে, চাহনিতে, অভিব্যক্তিতে, কথা বলার ভঙ্গীতে। আর আছে দারুণ আকর্ষণীয় শারীরিক সৌন্দর্য।
লক্ষ্য করলাম, শাঁওলী ওর বয়সী মেয়েদের মত একেবারেই সাজে নি। একটা সবুজ রঙের জামদানি শাড়ী পরনে। পিঠের ওপর চুলগুলো খোলা। তাতে নেই কোন ফুল গোঁজা বা ফুলের মালা জড়ানো। চোখে মুখে প্রসাধন বলতে হালকা একটু লিপস্টিক দিয়েছে ঠোঁটে, আর কপালে একটি সবুজ রঙের টিপ। কিন্তু ওর অপূর্ব সুন্দর কিন্তু একটু উদ্ধত অঙ্গভঙ্গি ওকে সবার চাইতে আলাদা করে দিয়েছে। আমাকে একদিকে বসিয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনায় ব্যস্ত হল। যেন নিজের মাঝে ডুবে আছে। আশপাশের এত হই চই তে ওর কোন আগ্রহ নেই। চুপচাপ নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে শুধু।
আমার বান্ধবীর কাছ থেকে আগেই কিছুটা শুনেছিলাম ওর কথা। আমি মানুষের মানুষিক সম্পর্কের টানাপড়েন, জটিলতা নিয়ে বেশ ভাবি, আর সম্ভব হলে সমাধান করতেও চেষ্টা করি, আমার বন্ধুদের অনেকেই সে কথা যানে। তাই আমার বান্ধবীটি আমাকে বলেছিল সুযোগ হলে শাঁওলীর সাথে কথা বলতে। ওর এমন একরোখা, উদ্ধত হবার কারণ কিছুটা জানি বলেই আমার মেয়েটির সাথে কথা বলতে বেশ ইচ্ছে করছিল। সুযোগটি পেয়ে গেলাম, কিছুক্ষণ পরে যখন আমন্ত্রিতরা সবাই মোটামুটি বসে গেছে, তখন মঞ্চে গানের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। সেই সময় শাঁওলী এলো আমি ঠিক আছি কিনা দেখতে। আমি ওকে আমার পাশে বসতে বললাম। মেয়েটি বসলো। তারপর আমাদের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল, তা ছিল এরকম….. আমি জিগ্যেস করলাম, “কেমন আছো”? একটু চুপ করে থেকে ও বলল, “খুব ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? খালার মুখে আপনার কথা শুনেছি”। “আমি ভালো আছি” এই বলে আবার জিগ্যেস করলাম, “আচ্ছা তোমার বোনের বিয়ে, আর তুমি একটুও সাজে নি কেন”? সাজতে ভালো লাগে না তোমার?
আমাকে অবাক করে দিয়ে খুব নির্বিকার ভাবে বলল, “সেজে কি হবে? সাজলেও তো আমাকে দেখতে সুন্দর লাগেনা। আমি তো রূপসী নই”… বলে একটু হাসল। আমি মনে মনে বেশ ধাক্কা খেলাম! দেখলাম বিদ্রূপের হাসি ওর ঠোঁটে, চোখদুটো মুহূর্তে জ্বলে উঠলো, বলল, “আর, আমি যেমন তেমনটি আমার পছন্দ। বাড়তি কোন সাজ আমার সত্যি ভালো লাগে না। সেজে সুন্দর হতেও চাইনা। দেখছেনই তো আল্লাহ আমাকে ইচ্ছে করে কুৎসিত বানিয়েছে। তাই তো আমাকে দেখে কারো পছন্দই হয় না। জানেন নিশ্চয়ই আমার যে বিয়ে হয়নি? আমার ছোটবোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে” – এইটুকু বলে ও থেমে গেল। আমার চারপাশে তখন রূপের হাট বসেছে। আমি কি বলবো যখন ভাবছি, তখন শাঁওলী আবার বলতে শুরু করলো, “আমি জানি, এই সমাজে ছেলে, ছেলের পরিবার সবাই সুন্দরী মেয়ে চায় বিয়ের জন্যে। আমার মত দেখতে যারা, তাদের হয় বিয়েই হয়না, আর যদি হয়ও, তা হয় অযোগ্য ছেলের সাথে। কিন্তু আমি জানি পুরুষগুলো কেন সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করে”? আমি জিগ্যেস করলাম, “কেন করে”?
ও বলল, “কেন আবার? দেখতে খুব ভালো লাগে, প্রেম প্রেম ভাব হয়। তাছাড়া সমাজে দেখানোর একটা ব্যাপার তো আছেই। আমার বউটি কত সুন্দর! আমাদের বাড়ীর বউটি কত সুন্দর! আর, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন দেখতে ভালো হয়, সেটিও একটি বড় কারণ। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর বউয়ের প্রতি আকর্ষণ কমে যায় ঐ পুরুষগুলোর, আর তখন এরা কি চায়, আমি তা জানি”-
এটুকু শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম, “কি জানো তুমি, আর কি করেই বা জানো”? আমি সেই মুহূর্তে ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছি অপ্রিয় সত্য কথাগুলো শোনার জন্যে।
শাঁওলী চাপা গলায় বলল, “একটু খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, এখানে কয়েকজন পুরুষ কিভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টাও করছে। ওরা কি দেখছে বলুন তো? আমার শরীরটাকে দেখছে। ওদের চোখের ভাষা আমি বুঝি। এও জানি, এরা কেউ আমাকে বিয়ে করবেনা। আমি যে সুন্দরী নই। আমি কালো, তাই। কিন্তু ওদের মধ্যে কেউ কেউ নির্লজ্জের মত আমাকে চায় কিন্তু… অন্যভাবে”। আমি শুনছি, দেখছি ওর কথায় স্পষ্ট ঘৃণা। “কিন্তু শাঁওলী, সব পুরুষ তো একরকম নয়” আমি বললাম। আমি ওর পুরুষ বিদ্বেষের কারণ বুঝতে পেরে ওকে বোঝাতে চাইলাম, কিন্তু ওকে যেন তখন কথা বলার নেশায় পেয়েছে, ও বলে চলল…….”জানেন, এখানে কয়েকজন আছে যারা আমাকে দেখেতে এসেছিল বিয়ের জন্যে, কিন্তু আমাকে পছন্দ হয়নি। নাকচ করে দিয়েছিল। আজ এসেছে সুন্দরী বউ কে নিয়ে। কিন্তু ভেতরের গল্প অন্যরকম। শুনবেন”?
আমি বুঝতে পারছিলাম তবুও আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম শুনব বলে।
“একটু আসছি”….বলে শাঁওলী উঠে গেলো কিছু সামাজিকতা করতে। ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর।
বললাম, “বল আমাকে, আমি শুনতে চাই” ও বলল, “এদের অনেকেই আমাদের পারিবারিক, বা সামাজিক বন্ধু, কেউ বা আত্মীয় কোন সূত্রে। ওরা আমার ফোন নম্বর যোগাড় করে আমাকে ফোন করে, বলে, আমার আপত্তি না থাকলে আমরা কোথাও দেখা করতে পারি। সময় কাটাতে পারি একসাথে। যেতে পারি লঙ ড্রাইভে ইত্যাদি”।
পুরনো কাহিনী হলেও শুনে আমি কেঁপে উঠলাম, এইটুকু একটি মেয়েকে এসব দেখতে হচ্ছে। জিগ্যেস করলাম তুমি তখন কি বল ওদের। ও বলল, “রং নাম্বার” বলে ফোন কেটে দেই।
আরও একবার আমার মনটা যন্ত্রণায়, ঘৃণায় বিষিয়ে গেলো। একটি অবিবাহিতা কম বয়সী মেয়ে এই দীর্ঘ জীবন হয়ত কাটাবে তীব্র ঘৃণা নিয়ে ! ওর ইচ্ছের কোন জায়গাই নেই। ওকে কেউ ওকে দয়া করে যদি বিয়ে করে তাহলে বিয়ে হবে, নয়তো হবে না! মনে মনে তখন নিজেকেই ধিক্কার দিতে শুরু করেছি। এই তথাকথিত শিক্ষিত, আধুনিক সমাজের আমিও তো একজন। কি কদর্য, কত ঘৃণ্য এই দিকটি। আমি লজ্জিত হলাম। এই সমাজের একজন সচেতন মানুষ হয়েও পারিনি একে নিষ্কলুষ করতে। পারছিনা হীনমন্যতার শেকড় উপড়ে ফেলতে। ভেবে অবাক হলাম, আজো এই আধুনিক যুগে গায়ের রং, মুখশ্রী একটি মেয়ের জীবনের গতিকে বদলে দেয়। এটা মানি যে, পছন্দ নাই হতে পারে বউ হিসেবে, কিন্তু তাহলে তারাই আবার কেন অন্য কারণে মেয়েটিকে কামনা করবে। আবার এই সমাজে এমন অনেক মেয়েও আছে, তারা যখন ছেলে পক্ষ, বিশেষ করে ছেলের মা, তখন তারা ভুলে যায় যে, সে একটি মেয়ে হয়ে আরেকটি মেয়েকে অপমান করছে।
এমন আরও কত হাজারও শাঁওলী আছে এ সমাজে যাদের সময়মত বিয়ে হয় না। বা কখনই হয় না।
কোন কথা সরে নি আমার মুখে। শুধু ওর হাতটা আমার হাতে নিয়ে বলেছিলাম, “সব ঠিক হয়ে যাবে”।
শাঁওলী নিঃসংকোচে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন সান্ত্বনা দিচ্ছেন? আমার তো এখন আর কোন কষ্ট নেই। হ্যাঁ, একসময় অনেক কষ্ট পেয়েছি। দিন রাত কেঁদেছি, সুন্দর হতে চেষ্টাও করছি। কিন্তু লাভ হয় নি। একসময় নিজের প্রতি করুণা হয়েছে। কিন্তু এখন আমি আর ওসব ভাবি না। আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। আমার শক্তিকে খুঁজে পেয়েছি। আমার এখন অমন অবলম্বন চাই না। আমি খুশি যে আমি ঐসব পুরুষদের আসল রূপটা দেখে ফেলেছি। ওদের প্রত্যাখ্যান করতে শিখেছি।
আমি এও জানি হয়ত কোথাও কেউ একজন আছে, যে সত্যিকারের পুরুষ মানুষ“।
“তুমি কি অপেক্ষায় আছো সেই পুরুষের”? আমি জানতে চাইলাম,
ও বলল, “না, আমি অপেক্ষা করছি না তার জন্যে, যে আছে সে থাক। কিন্তু আমি তো আর একা নই”।
আমি খুশী হয়ে জানতে চাইলাম, ওহ! তুমি তাহলে পেয়েছ তোমার পছন্দের মানুষটিকে?”
ও হেসে বলল, নাহ — তেমন পাওয়া নয়, সে আছে আমার মনে।“
আমার অসুন্দর চেহারা, আমার কালো রং তার খুব প্রিয়, কারণ সে যে ভালোবাসে আমাকে। সে আমার প্রাণ পুরুষ। যে কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবে না।
আর কিছু চাইনা আমি কারো কাছে। আমার সৃষ্টি কর্তার কাছেও না। সেই যানে সে কেন একই মায়ের গর্ভে দুই মেয়ের জন্ম দিয়েছে, একজন কে রূপসী বানিয়ে, আর, অন্যজন কে …… শাঁওলী থেমে গেল। বুঝলাম যুদ্ধ করে নিজেকে সামলাচ্ছে – কি উত্তর দেব আমি ওকে? দুজনই চুপ করে থাকলাম।
এবার বুঝি শাঁওলীর কথা শেষ হল। তাকিয়ে দেখলাম, ও তখন মঞ্চের দিকে কেমন অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে যেখানে তখন নাচ গানের মহোৎসব চলছে। ওরই ছোট বোন ফুলের সাজে সেজে অপরূপা হয়ে বসে আছে। কত স্বপ্ন ওর চোখে। আর শাঁওলীর দুচোখে কান্না জল টলমল করছে। ওর ভেতরটা যেন দেখতে পেলাম। বাইরের এই উদ্ধত, বেপরোয়া ভাবটার নীচে নরম কমল মনটা সমাজের নিষ্ঠুর, ঘৃণ্য আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে আছে সেই মনটাকে যেন দেখতে পেলাম। অথচ এ সমাজেই অনেক পুরুষ আছে যারা প্রকৃত ভালো মানুষ। মনে মনে খুব কামনা করলাম, এই মেয়েটি যেন একদিন তেমন কোন ভালো মানুষের দেখা পায়।
শাঁওলীকে কিছু বলা হল না আমার। একটু পরেই নিজেকে সামলে নিল মেয়েটি! বুঝলাম নিজের সাথে কথা বলে ও নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। ধীরে ধীরে ওর চোখে মুখে অপূর্ব আলোক দ্যুতি ফুটে উঠলো। “এবার আমি আসি, আপনি খেয়ে নিন প্লিজ” বলে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে হেঁটে গেলো আত্মপ্র্ত্তয়ী শাঁওলী।
আমি কিছুটা হলেও দেখেছি শাঁওলীর আত্মপ্রত্যয়, অন্তর–শক্তি, আর প্রচণ্ড আত্মমর্যাদা বোধ।
আর এসবই ওকে ওর নিজের একটি সম্মানজনক পরিচয় তৈরি করতে সাহায্য করেছে। ও নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে না না কাজে। ও এখন একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আমার সাথে সেই থেকে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কথা হয়, দেখাও হয়। একদিন এক অবসরে হঠাৎ ফোন করে বলল, “জানেন, আমার প্রেমিক কি বলেছে আমাকে? বলেছে, আমি নাকি ওকে রূপে নয়, ভালোবাসায় ভরিয়েছি। আর তাই তো সে আমাকে আমার চেয়েও বেশী ভালবাসে। থাকে আমার সাথে, আমাকে চারপাশ থেকে বেঁধে রাখে আদরে, মমতায়, ভালবাসায়”- বলে হা হা করে হাসতে থাকলো।
আমি বুঝলাম ওর ভেতরের প্রেমিকা মনটি মরে যায় নি, বরং ও মনের মাঝে একজন অলীক পুরুষকে ভালবেসে নিজের একটি জগত তৈরি করে নিয়েছে। যে ওকে ভালবাসে ও যেরকম ঠিক সেই মেয়েটিকে। এই ভাবনার সুখ টুকুই ওর সুখ, শান্তি। হয়তো অপেক্ষা করে মনে মনে সেই পুরুষের, কিন্তু সেকথা ও কাউকে বুঝতে দেয় না। মাথা উঁচু করে চলে নিজের তৈরি করা পথে।
#আমি_চিত্রাঙ্গদা
গল্প ৪ – তাজের মা
– ইসমাত সুলতানা
সময় হল, গল্প শোনাবার। আমি ইসমাত, আমার “অল্প স্বল্প গল্প” নিয়ে চলে এলাম।
আমার প্রিয় শ্রোতা বন্ধু, শুভেচ্ছা নিন। ভালো আছেন তো? গেল সপ্তায় যাবার আগে বলেছিলাম, জীবনকে উপভোগ করতে, কারণ একটাই তো জীবন। আমি জানি আমার সাথে আপনারা একমত হবেন যে একেক জনের কাছে জীবনের মানে একেক রকম। জীবনে প্রাপ্তির উৎসও আলাদা আলাদা। তবে আমি মনে করি জীবনে পাওয়ার চেয়ে দেয়ার আনন্দ অনেক বেশী। মন প্রাণ খুলে যার যা প্রাপ্য তা দিতে পারলে বেঁচে থাকার অর্থ নতুন মাত্রা পেতে পারে…… আর যারা দেয়ার ভাগ্য নিয়ে জন্মায় নি, যাদের হাত পেতে অন্যের কাছ থেকে নিতে হয় তাদের জীবন তো সুখের হতে পারে না, তাইনা? তাদেরও একটাই জীবন, কিন্তু এই একটা জীবন শেষ বয়সে এসে যে কতটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, সে কথা আমরা জানলেও, তাদের খবর ক’জন রাখি বলুন? এমনকি আমাদের আশেপাশের নিঃসহায়, নিঃসম্বল গরীব মানুষদের খবরও আমরা সেভাবে রাখি না। অথচ সামাজিক মানুষ হিসেবে, সেটা আমাদের করনীয়। সব কটা ধর্মও সেই একই বিধান দেয়। কিন্তু আমাদের ব্যস্ততা, আমাদের স্বার্থপরতা, বেশিরভাগ সময় আমাদেরকে সে সব করণীও থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তেমনই অসহায় এক বৃদ্ধার গল্প বলবো আজ —
তাঁর নাম কি, আমি আজও জানি না।
কোনদিন জিগ্যেস করাই হয়নি এতগুলো বছরে
তাঁর পরিচয়, সে ‘তাজের মা’,
এ বাড়িতেই কাজ করেছে ….. তা হবে প্রায় ২৫/২৬ বছর!
অনেক বয়স অব্ধি কাজ করে যাচ্ছিল। আমরা অনেকবার বলেছি কাজ ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম নিতে। তাঁর ভরন পোষণের দায়িত্ব আমাদেরই থাকবে, সে আশ্বাসও দিয়েছি। কিন্তু কোনোভাবে তাঁকে আমরা রাজি করাতে পারি নি। কাজ না করে আমাদের কাছে থাকাটা নাকি অনুগ্রহ নেয়া, তাই সেটা সে নিতে চায় নি। তাঁর এই আত্মসম্মানবোধ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি! যাহোক, শেষ পর্যন্ত যখন শরীর আর কুলিয়ে উঠতে পারলো না, তখন সে নিজেই বাধ্য হল কাজ থেকে অব্যাহতি নিতে। আমরা এক রকম যোর করে তাঁকে রাজি করালাম মাসে মাসে পেনসনের টাকাটা নিতে।
সে এখন ছেলের সংসারে অপ্রয়োজনীয় মা। তাঁর দিন কাটে, না কাটার যন্ত্রণা আর অফুরন্ত সময়ের অসহনীয় ভার বয়ে। বাধ্য হয়ে অবসর নেয়া জীবনে রোগ যেন আরও জাঁকিয়ে বসলো। শুরু হল তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়, অযত্ন, অবহেলার সাথে এখন তাঁর বসবাস।
শুনেছিলাম উচ্চ রক্তচাপ নাকি রাজকীয় রোগ, শুধু পয়সাওয়ালাদেরই হয়,
কিন্তু এই রোগ আজকাল সেই শ্রেণী বিভেদ ভুলে গেছে
এখন সে হতো-দরিদ্রকেও ছাড়ে না, তাজের মা’কেও ছাড়ে নি। সেই সাথে বার্ধক্য জনিত অন্য অসুস্থতা তো আছেই। এসব স্বত্বেও তাজের মা মাঝে মাঝেই আসে এ বাড়িতে, একটু ঘুরে যায়, দেখে যায়, দেখা দিয়ে যায়।
কালে ভদ্রে আমার সাথে দেখা হয়ে গেলে, আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে কোনদিন ভুল হয়না তাঁর! আর আমি, আমি সেই আদরটুকু গ্রহণ করি আমার তথাকথিত শ্রেণীগত অবস্থান, বিভেদকে পরোয়া না করে। সে তখন মন ভরে দোয়া করে আমাকে।
এর মাঝে অনেক দিন পেরিয়ে গেছে তাজের মা আসেনি। আমি একবার খোঁজ করে জেনেছিলাম যে সে গুরুতর অসুস্থ। তখন প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য দিয়েই আমাদের দায়টা সেরেছিলাম। কিন্তু পরে আর সেভাবে খবর রাখি নি।
অনেকদিন পরে আজ দুপুরে হঠাৎ যখন এলো, তখন মনে হল, তাইতো, তাজের ‘মা তো অনেকদিন পরে এলো! তাকিয়ে দেখলাম , অনেক রোগা হয়ে গেছে। জানতে চাইলাম এতদিন আসে নি কেন? বলল, স্ট্রোক করেছিল। আর তাই অনেকদিন খুব অসুস্থ ছিল। সে জন্যেই আসতে পারে নি। শরীরটা একটু ভালো মনে হতেই চলে এসেছে আমাদের দেখতে। মনে পড়ে গেল আমার সে কথা। শুনেছিলাম হাই ব্লাড প্রেশার তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। বিধাতা অশেষ কৃপা করেছেন বলে এ যাত্রা বেঁচে গেছে। হেঁটে চলে বেড়াতে পারছে, শুধু, কথাটা যেন একটু জড়িয়ে গেছে!
খুব খারাপ লাগলো আমার যে, সে আমাকে দেখতে এই শরীরে দোতলায় উঠে এসেছে। আমাকে নীচে ডেকে পাঠালেই তো পারতো, আমি, আমি সেকথা বললামও। তাজের মা, একটু হেসে বলল,
‘আমার কোন কষ্ট হয় নাই গো ভাবি, আপনারে দেখলে মনডায় অনেক শান্তি লাগে, আমি আসতে আসতে উইঠা আইছি”। একটু জিরাইলে ঠিক হইয়া যাইব। আপনের শরিলডা কেমন গো ভাবি? আমার ভাইয়ে, আমার বাবায় কেমন আছে…” তাঁর কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। আমি বুঝি, আমাকে নীচ তলায় ডেকে পাঠানোটা ওর জন্যে ধৃষ্টতা হতো, আমি যে মালিক পক্ষ!
তাই সে কষ্ট করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এসেছে আমাকে দেখতে। ওই যে বলেছি, আমাকে খুব ভালবাসে, স্নেহ করে! তাই আমাকে না দেখে চলেও যেতে পারে নি।
ভালো করে তাকিয়ে দেখে বুঝলাম, একেবারেই যত্ন হয় না। শীর্ণ দেহে হাড়ের ওপরে চামড়া শুধু জড়ানো। কিছু টাকা দিলাম যেন পথ্যটা ঠিক মত কিনে খেতে পারে। টাকাটা নিতে নিতে আবেগে আপ্লুত তাজের মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। তারপর, তাঁর শ্রেণী অবস্থান ভুলে গিয়ে প্রথমবারের মতো আমার কপালে স্নেহ-চুম্বন এঁকে দিল! আমি দুহাতে জড়িয়ে ধরলাম এই বৃদ্ধাকে। একটু পরে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল অনেক দোয়া আওড়াতে আওড়াতে — আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই অসহায় প্রস্থান।
আমার মনে আমার নিজের মা’র মুখটা ভেসে উঠলো, একই বয়স হবে হয়তো দুজনের।
মনে হোল, আমার জন্ম হতেই পারতো তাজের মা’র গর্ভে! সে তো আমার মা হতেই পারতো!
সৃষ্টিকর্তা আমাকে দয়া করেছেন, তাই আমি জন্মেছি অন্য একটি পরিবারে। মধ্যবিত্তের ঘরে। তাই আমার ভাগ্যে শিক্ষা দীক্ষার সুযোগ হয়েছে। আজ আমি সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। সমাজের সুবিধাভোগীদের একজন। এমনটি তো নাও হতে পারতো! আমার ভাগ্যে তো বস্তি জীবন লিখা থাকতে পারতো জন্মগত ভাবে!
কিন্তু তাজের মা’রা কেন তেমন দয়া পায় না সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে? কোন অপরাধে ওদের ভাগ্যের বাতি নিভু নিভু হয়ে জ্বলে? এ কেমন বঞ্চনা জন্ম থেকে বাকী সারাটা জীবন জুড়ে? ওদের মধ্যে কজন পারে নিজেদের ভাগ্য বদলাতে? স্বয়ং খোদা যখন এমন বৈষম্যের সৃষ্টি করেছেন, তখন, আমরা তো স্বার্থপর, সাধারণ মানুষ!
আমার চিরকালের প্রশ্ন বিচলিত করলো আমাকে আরও একবার।
মনে হোল, জন্ম থেকে মৃত্যু এই বিশাল যাত্রায় তাজের মায়েদের ভাগ্যের তেমন একটা পরিবর্তন হয় না।
কেবল ঠিকানাটা বদলে যায় বার কয়েক…..জন্মই ঠিক করে দেয় কে দাঁড়াবে কোন সারিতে!
আমাদের অনেকের বাড়িতেই এমন পুরনো গৃহ পরিচারিকা থাকে, যাদের ছাড়া আমাদের চলাটা অনেক কষ্টকর। দীর্ঘ দিন একসাথে একই পরিমণ্ডলে থাকতে থাকতে ওরাও পরিবারের অংশ হয়ে ওঠে ঠিকই, কিন্তু যখন ওরা আর আমাদের কাজে আসেনা, তখন আমরা ক’জন ওদের দেখা শোনা করি? ওদের খোঁজখবর রাখি? খুব কম, খুবই কম! তাই আমি ভাবি কি করে এই অসহায় দরিদ্র মানুষগুলোকে একটু আরাম দেয়া যায় তাঁদের জীবনের শেষ দিনগুলোতে?
#আমি_চিত্রাঙ্গদা
ডিসেম্বর ২৫, ২০১৬
গল্প ৩ – নীলকণ্ঠ সুখ
– ইসমাত সুলতানা
প্রিয় শ্রোতা বন্ধু, আমার শুভেচ্ছা নিন J আমি ইসমাত, চলে এসেছি আমার অনুষ্ঠান – অল্প স্বল্প গল্প নিয়ে J কেমন ছিলেন এই কদিন? আশা করি ভালো ছিলেন। দেখতে দেখতে একটি সপ্তা পার হয়ে গেল, আজ আবার আমার গল্প বলার পালা। আজ আমি আপনাদের প্রেমের গল্প শোনাবো। ঠিক গতানুগতিক প্রেম নয়, বেশ অন্যরকম, অদ্ভুত এক প্রেমের গল্প!
মানুষের মনের জগত যে বিচিত্র এক জগত, সেকথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এতোটাও বিচিত্র হতে পারে, তা আমার অজানাই থেকে যেত, যদি না এই গল্পটি আমি শুনতাম। গল্পটির নায়ক, আমার বন্ধু, শফিক।
শফিক তখন সদ্য এম বি বি এস পাশ করে, ইন্টার্নশিপ শেষ করে একটি সরকারি হাঁসপাতালে ডাক্তারি শুরু করেছে। তখন একে একে ওর বেশ কয়েকজন বন্ধু বিয়ে করে ফেললো। কারো প্রেমের বিয়ে হচ্ছে তো কেউ আবার বাবা মায়ের পছন্দেই বিয়ে করছে। শফিকের গোটা ছাত্র জীবনে কখনো প্রেম করা হয়ে ওঠে নি। অগত্যা মা বাবা যাকে পছন্দ করবে তাকেই বিয়ে করতে হবে। তাই ওর বাড়ি থেকে যখন বিয়ের জন্যে ওকে বলা হল, শফিক তখন না…এখন না, আরও কিছুদিন যাক, একটু পায়ে দাঁড়িয়ে নেই ইত্যাদি ইত্যাদি… এসব তাল বাহানা করে কিছুদিন আটকে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত আর আটকাতে পারলো না। এদিকে বাড়ি থেকে আগেই পাত্রি দেখা শুরু গিয়েছিল। যে পাত্রিটিকে তাদের সবার মনে ধরল, সে মেয়েটির নাম নীলা, মেয়েটি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ সম্মানের ছাত্রি। মেয়েটিকে শফিকদের বাড়ীর সবার পছন্দ হল। কিন্তু শফিক মেয়েটিকে দেখে নি। তবে না দেখেও সব কিছু শুনে মনে মনে ভালো লাগা তৈরি হয় মেয়েটির প্রতি। (একটু হেসে) মেয়েটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেও শুরু করে।
(একটু ভারী গলায়) কিন্তু সে স্বপ্ন আর বাস্তব হতে পারলো না। মেয়ের মা ছেলেকে পছন্দ করলেন না। কারণ, ছেলের গায়ের রং কালো! কৃষ্ণ বর্ণের ছেলের সাথে তার গৌর বর্ণের মেয়ের বিয়ে হয় কি করে? তার ফর্সা জামাই চাই। মায়ের কথার উপর কথা বলার সাহস ছিল না মেয়ের বা পরিবারের অন্য কারোর। নীলার বাবা চেষ্টা করেছিলেন মা কে বোঝাতে, যে ছেলেটি পাত্র হিসেবে অনেক ভালো। হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। কিন্তু মাকে রাজি করানো গেল না কিছুতেই। তাই বিয়ের কথা আর এগুলো না। এতে শফিকের মনটা ভাংলতো বটেই, সেই সাথে ওর আত্মসম্মানেও খুব লাগলো। এই প্রত্যাখ্যান সহ্য করার মত নয়। কিন্তু… তবুও খুব অদ্ভুতভাবে শফিকের মনে নীলার জন্যে ভালো লাগা তৈরি হয়ে যায়। অদ্ভুত এক ভালো লাগা… না দেখা মেয়েটির প্রতি!!!
এদিকে শফিকের বাড়ি থেকে তখন আরও জোরে সোরে মেয়ে খোঁজা শুরু হল। সমাজে ডাক্তার ছেলের অনেক কদর, তাই বেশী দেরী করতে হল না। মানাসই মেয়েও পাওয়া গেল। ধুমধাম করে বিয়েও হয়ে গেল ওদের। একজন জীবনসঙ্গীনি নিয়ে নতুন জীবন শুরু হল শফিকের। মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরোয়া মেয়ে শায়লা। দেখতে শুনতে আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই। ওদের দুজনের সংসারের চাকা গড়াতে শুরু করে।
কিন্তু… মাঝে মাঝেই শফিকের মনের গভীরে সেই প্রত্যাক্ষানের অপমানবোধ ওকে কষ্ট দেয়। একটা ক্ষোভ। কিন্তু সহ্য করা ছাড়া কিছু তো করার নেই। তবুও শফিক ধীরে ধীরে নীলার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। কখনো না দেখা মেয়েটি ওর মনে বিশেষ জায়গা করে নেয়। শফিক মেয়েটিকে নিজের অজান্তেই কখন যে ভালবাসতে শুরু করেছে বুঝতেও পারে নি।
ওদিকে নীলার মা নীলার জন্যে গৌর বর্ণের পাত্র খুঁজে পেল। পাত্র শফিকেরই এক সিনিয়র ডাক্তার। ওদেরও বিয়ে হয়ে গেল। এপর্যন্ত সব কিছু স্বাভাবিকই ছিল, কিন্তু নীলার মা’এর স্বভাবটি এমন যে, শুধু নিজের পরিবারেই নয়, তার সন্তানদের বিবাহিত জীবনেও ভীষণ ভাবে হস্তখেপ করাটা তাঁর অভ্যাস। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠীয়েও মেয়ের সংসারে নিজের মতামত খাঁটাতে শুরু করে দেয়। মেয়ে ওর সংসারে কি করবে না করবে সেটিও ওর মাই ঠিক করে দেয়।
এমন না না কারনে নীলার সংসারে ধীরে ধীরে অশান্তি নেমে আসে। নীলা কোন রকমে সংসার করে যাচ্ছিল কিন্তু মেয়েটি ভালো থাকতে পারছিল না। এক সময় ওদের স্বামি-স্ত্রির মাঝে অশান্তি এত বেড়ে যায় যে ওরা আর একসাথে থাকতে পারে না। খুব দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। নীলা ফিরে আসে বাবা মার সংসারে।
এদিকে, শফিক তার ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সংসার ধর্ম পালন করছে ঠিকই। কিন্তু স্ত্রি কে সেভাবে ভালবাসতে পারলো না। কি করে পারবে? ও যে নীলাকে ভালবাসে!! যে ভালোবাসার জন্ম, তার বিস্তারে ওর তো কোন হাতই ছিল না। কোথা থেকে এলো এই অনুভুতি, নিজেও অবাক হয়ে যায়! তবে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালনে কোন অবহেলা করে না শফিক। ওর স্ত্রি কিছু বুঝতে পারে না, যে ওর স্বামীর মন জুড়ে আরেকটি মেয়ে বাস করছে। গতানুগতিক পারিবারিক জীবনে ওরা অভ্যাস্থ হয়ে ওঠে। বছর দুয়েক পরে ওদের একটি মেয়ে সন্তান হয়। এবার যেন শফিকের সংসারের প্রতি টানটা বাড়ল।
তারপরেও একাকী মুহূর্তগুলোতে শফিক নীলাকে নিয়ে কত কিছু ভাবে। নিজের মত করে ভালবাসতে থাকে। একদিন হঠাৎই এক বন্ধুর কাছ থেকে নীলার ঘর ভাঙার খবরটি জানতে পারে ও। খবরটি শোনার পর ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় আর সেই সাথে খুব মায়া হয় নীলার জন্য। এরপর থেকে যেন নীলার জন্য শফিকের ভালবাসার মাত্রা বেড়ে গেল অনেক গুন!! মেয়েটি যে সুখ পেল না সে কথা ভেবে ওর খুব কষ্ট হয়। নিজের মনেই ভাবে… ও যদি নীলা কে কাছে পেত, তাহলে ওকে ভালবাসায়, আদরে ভরে দিত। এতটুকু কষ্ট পেতে দিত না মেয়েটিকে। মনে মনে খুঁজে ফেরে নীলাকে। কিন্তু দেখা করার তো কোন সুযোগ নেই। ওরা আলাদা আলাদা শহরে থাকে। তাছাড়া, ও তখন জীবনে এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে এখন ওসব ভাবাটাও বেমানান। ওর নিজের সংসার, স্ত্রি, সন্তান, সামাজিক অবস্থান, এসব কিছু ওকে এমন ভাবনা ভাবতে অনুমতি দেয় না। কিন্তু মনকে সামলাবে কি করে? তাই সেই ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজে এক ধরনের সুখ অনুভব করে।
ভাবনা, অনুভব, অনুভূতি এসব কে তো মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তাই, শফিকের মনেও বড় অদ্ভুত একটি ভাবনা জন্ম নিল। শফিক এখন ভাবে… ওর পক্ষে যদি সম্ভব হতো, তাহলে সে নীলাকে – বিয়ে করত! একেবারে নিজের করে নিয়ে ভালোবাসায়, আদরে, সোহাগে মুড়ে নীলার সব কষ্ট দূর করে দিত। বুকের মাঝে এমনভাবে আগলে রাখত যেন আর কখনো, কোনদিন ওর নীলা, আর কোন কষ্ট না পায়।
আমার সাথে শফিকের বন্ধুত্ব হয় ঘটনাক্রমে। আমি জানি না কেন নিজে থেকেই নিঃসংকোচে এসব কথা আমায় বলে। শেষটা শুনে আমি চমকে উঠি, কি বলছে এই ভদ্রলোক! ঊনি বিবাহিত… তবুও উনি মনে মনে নীলাকে বিয়ে করার মত এমন একটি ইচ্ছের লালন পালন করছেন! কথাটায় আমি ভীষণভাবে চমৎকৃত হই। কথাটি আমাকে বেশ ভাবায়। ভালবাসলে যে অনেক সামাজিক, পারিবারিক নিয়মের বাইরেও মন যেতে চায়, অনেক ইচ্ছা-অনিচ্ছা মানুষের মনে আসে, সেসব আমি বুঝি। সেসব হয়তো বাস্তবায়ন হয় না অনেক কারনে। কিন্তু ইচ্ছে হওয়াটা ঠেকাবে কে? তাই শফিকের মনের এই অপ্রচলিত ভাবনাকে আমি বুঝতে পারি। বুঝতে পারি কোন ভালবাসার টানে, কোন মায়ায় শফিকের মনে নীলাকে বিয়ে করার মত এমন একটি ইচ্ছে জায়গা করে নিয়েছে। অথচ, এই মেয়েটাকে সে কোনদিন দেখেই নি! এখানেই আমার ভাবনা অন্য মাত্রা খুঁজে পায়। আমি বুঝি, শফিক সেই শুরু থেকে একটি স্বপ্নের জগত তৈরি করেছিল নীলাকে নিয়ে। যে জগতে সে নিজে বিবাহিত নয়। নীলা যতদিন বিবাহিতা ছিল, তখন সে নিজেকে ব্যর্থ প্রেমিকের ভুমিকায় কল্পনা করেছে, কিন্ত নীলার বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনাটি ওর মনে আর কোন বাঁধা রাখে নি। তাই ও নির্দ্বিধায় ভাবতে পারে, মুখ ফুটে বলতে পারে যে ও নীলাকে বিয়ে করে সুখী করতে চায়! ও কিন্তু একবারও আমাকে বলে নি সে নিজে সুখী হবার জন্যে এমনটি করতে চায়, বলেছে ও নীলাকে সুখী করতে চায়!! কিন্তু ও যানে ও পারবে না। পারিবারিক দায়িত্ব, কর্তব্য ওকে এমনটি করতে দেবে না। তাই বুক ভারী করা অসহায়ত্বের কষ্ট নিয়ে নিজের মনে স্বপ্ন বুনে চলে শফিক। নীলার হাত ধরে হেঁটে যায় ওর একান্ত প্রেম রাজ্যের পথে। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই দুচোখের কোন ভরে যায় পানিতে।
শুরুতেই বলেছিলাম, কত বিচিত্র মানুষের মন আর তার ভাবনা, তার স্বপ্ন। শফিকও বাস করছে তার স্বপ্ন রাজ্যে এক অসম্ভবকে ভালবেসে।
বড় অদ্ভুত, তাই না?
#আমি_চিত্রাঙ্গদা
ডিসেম্বর ১৪, ২০১৬
গল্প ২
আমার মানচিত্র জুড়ে এক বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন?
– ইসমাত সুলতানা
আমার প্রিয় বন্ধু, শুভেচ্ছা নিন। কেমন আছেন আপনারা? নিশ্চয়ই ভালো।
আমি চলে এলাম আপনাদের কাছে আমার গল্প নিয়ে। এই সত্যটি তো সবাই মানেন যে, কিছু পেতে হলে, কিছু হারাতেই হবে। তেমনি এক পরম পাওয়া – আমারদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব । আজ থেকে ৪৫ বছর আগে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। সেই থেকে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাস শুরু হলেই বাংলাদেশ মেতে ওঠে উৎসব আয়োজনে। কতরকম আয়োজন চলে সাড়া দেশ জুড়ে, এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশি সমাজেও। কিন্তু এই স্বাধীনতা পেতে অনেক বেশী মূল্য দিতে হয়েছিল আমাদের । মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত লোমহর্ষক কাহিনী শুনেছি । অনেক গল্প, উপন্যাস লেখা হয়েছে। হয়েছে অনেক সিনেমা, নাটক এই মুক্তি যুদ্ধের নানা দিক নিয়ে । কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে পাক বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় যে ঘৃণ্য অত্যাচার চালিয়েছিল আমাদের মেয়েদের উপর, তাঁদের নিয়ে খুব বেশী কিছু হয়েছে কি? আপনাদের কি মনে হয়? সেই সব দুর্ভাগা মা-বোনেরা কি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে? আমার তো মনে হয় না। আজ আমি তাঁদেরই একজনের গল্প বলব তাঁর নাম আলেয়া। একজন মুক্তিযোদ্ধা । গল্পটি আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা। আম্মা যখন গল্পটি বলছিলেন, শুনতে শুনতে কখন যে আমিও চলে গিয়েছিলাম সেই সময়ে, সেই ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী যেন আমিও,বুঝতেই পারিনি। মনে হল যেন আমার সামনেই সব ঘটছে, সব কিছু। আমি মানস চোখে দেখতে পেলাম যেন —–
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি কোন একটা সময়। তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাড়ায় পাড়ায় নানা বয়সী ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তরুণদের মধ্যে উত্তেজনা সবচে বেশী। ওরা গোপনে মিটিং করত, কিভাবে ওরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবে। দেশকে স্বাধীন করতেই হবে। আমাদের পাড়ায় যে ছেলেটি ওদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল তার নাম আলি। ২৫/২৬ বছরের টগবগে এক তরুণ ! একদিন ও গোপনে চলে গেল ট্রেনিং নিতে । তারপর সরাসরি যুদ্ধ করবে। এ খবর কিভাবে যেন এ তল্লাটের বাঙ্গালী রাজাকারদের কানে গেল। একদিন রাজাকারদের কয়েকজন আলীদের বাড়ি এসে আলি কোথায় জানতে চাইল। কিন্তু আলীর বাড়ি থেকে কেউ মুখ খুলল না। ওর বাবা শুধু বললেন, আমরা জানিনা, আলী কোথায় আছে। রাজাকারগুলো ওদের নানা রকম ভাবে শাসিয়ে গেল। তার কিছু দিন পরে আলীর ছোট বোন আলেয়া, ১৮/১৯ বছর বয়সের তরুণী। কলেজে বি এ পড়ছে। বিয়ের বয়স তাই এই যুদ্ধের মধ্যেও বিয়ের প্রস্তাব আসা বন্ধ হয়নি । ও তখন এক রকম বাধ্য হয়েই মা’কে খুব ভয়ে ভয়ে বলল যে, ও পাড়ার ছেলে আদিবের সাথে ওর সম্পর্ক আছে। ওরা বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্তও নিয়েছে। ছেলেটি আলির বন্ধু। সেও আলীর মতোই যুদ্ধে গেছে। ওর জন্যেই আলেয়া অপেক্ষা করবে। অন্য কোথাও বিয়ে করা সম্ভব না। এ নিয়ে মা’ ওকে অনেক বুঝিয়েছেন, যে কবে যুদ্ধ শেষ হবে তার ঠিক নেই। ওঁরা কতদিন সমত্ত মেয়ে ঘরে রাখবেন ? দিনকাল খুব খারাপ। মা-বাবা’র ঘুম হয় না রাতের পর রাত। তবু আলেয়া কিছুতেই রাজি হয় না। এসব নিয়ে সেদিন ওর মন খুব খারাপ ছিল। তাই বিকেলে মা’কে বলে পাশের পাড়ায় বান্ধবীর বাড়ি গেল, যদি একটু ভালো লাগে। বলে গেল সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে। ফিরছিলও তাই। কিন্তু মাঝ পথে পাড়ারই একটা ছেলে রিপন, ওর কাছে এসে বলল যে, “আলেয়া আপা, আলীর ভাই খুব অসুস্থ, কিন্তু রাজাকারদের ভয়ে সে বাড়ি আসতে পারছেনা। তাই আমাকে বলেছে, আমি যেন আপনাকে আলীর ভাইর কাছে নিয়ে যাই, খুব দরকারি কথা নাকি বলার আছে আপনাকে”। একথা শুনে আলেয়া কোন সাত পাঁচ ভাবল না। মনে হল এখুনি যেতে হবে ওর ভাইজানের কাছে । কিন্তু বাড়িতে বলতে গেলে যদি দেরী হয়ে যায়, তাই না বলেই নির্দ্বিধায় ছেলেটির সাথে হাঁটতে শুরে করলো। এতদিন পরে ভাইজানকে দেখার আকুলতায় তখন ওর খেয়ালই হয়নি যে সন্ধ্যা হতে বেশী দেরি নেই।
পথে আলেয়া রিপনকে জিগ্যেস করলো, “ভাইজান এত দূরে কেন আছে রে?”
রিপন বলল, “ঐ যে বললাম, রাজাকারদের ভয়ে। ভয় নাই আলেয়া আপা, আমিতো আছি আপনার সাথে। তাড়াতাড়ি চলেন”।
প্রায় ৩০ মিনিট মত হাঁটার পর ওরা এসে বাড়িটির সামনে পৌছুলো, তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। আলেয়া আসতে আসতেই খেয়াল করেছে, জায়গাটি অপরিচিত, আর বেশ নিরিবিলি। বাড়ীর ভিতরে ঢুকতেই ওর গা ছম ছম করে উঠল। এটি একটি পোড়ো বাড়ি। ভিতরটা আবছায়া অন্ধকার । বারান্দায় কোন বাতি নেই। কয়েকটি ঘরের মধ্যে শুধু একটি ঘরেই আলো দেখতে পেল। রিপন বলল, “আলেয়া আপা, আলী ভাই ঐ ঘরে আছেন । আপনি জান, আমি একটু পরে এসে আপনাকে বাড়ি নিয়ে যাব”। “আচ্ছা” বলে আলেয়া এগিয়ে গেল ঘরের দিকে । ঘরটির ভিতরে পা দিয়ে ভাইজান বলে ডাকতেই দেখল দুজন অপরিচিত লোক ঘরে। ঘরটিতে তেমন কোন আসবাব পত্র নেই। থাকার মধ্যে একটি টেবিল। তার সামনে রাখা চেয়ারে বসে আছে একজন। আর অন্যজন বসে আছে দেয়ালের সাথে লাগান তক্তপোষটার উপরে। টেবিলটির উপরে মিট মিট করে হারিকেন জ্বলছে। সেই আলোয় আলেয়া ভালো করে ঘরের চারপাশে খুঁজল। না, ভাইজান এখানে নেই। ততোক্ষণে ভিতরে ভিতরে ও প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। কিন্তু ওদের সেটা বুঝতে না দিয়ে অনেক চেষ্টা করে কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে জিগ্যেস করলো, “ভাইজান কোথায়? আর আপনারা কারা”? যে লোকটি বিছানায় বসে ছিল, সে উঠে আসতে আসতে বলল, “তোমার ভাইজান জাহান্নামে, সেখানেই থাকতে দাও। মুক্তিবাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। দেশ বাঁচাতে চায়? এবার দেখি বোনের ইজ্জত কিভাবে বাঁচায়?”বলেই লোকটি আলেয়ার কাছে এসে ওকে ধরে নিয়ে গেল বিছানার কাছে। আলেয়ার পায়ের তলার মাটি সরে গেছে তখন। যা বোঝার ও বুঝল, নিজেকে রক্ষা করতে যথা সাধ্য চেষ্টাও করলো, কিন্তু কি করে পারবে নর পিশাচের শারীরিক শক্তির সাথে? ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করছে। কিন্তু ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো যে, ও মরে গেলেও এই জানোয়ারদের কাছে দয়া চাইবে না। শুধু আল্লাহ্কে বলল,তিনি যেন এদের বিচার করেন।
এরপর সারা রাত ধরে ওর উপর চলেছে দুই পশুর পাশবিক নির্যাতন। এরই মাঝে বাবা, মা, ছোট দুটি ভাই বোন, আর ভাইজানের মুখ বার বার ভেসে উঠেছে। না জানি কি অসম্ভব দুশ্চিন্তায় আছেন তাঁরা। আর মনে এসেছে ওর ভালোবাসার মানুষটির মুখ। মনে হল, ও কোন নোংরা নর্দমায় পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায় । শরীরটি বিষাক্ত সাপের ছোবলে ক্ষত বিক্ষত। এসব ভাবতে ভাবতে আযান কানে আসতে বুঝল ভোর হয়ে গেছে। ও শুনতে পেল লোক দুটি তখন নিজেদের মধ্যে বলা বলি করছে, নামায পড়ে ক্যাম্পে যাবে, তারপর খান সাহেবকে নিয়ে ফিরে আসবে এখানে। কথাটি শুনে আলেয়া ঘৃণায়, ভয়ে কুঁকড়ে গেল। দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এখন চোখ জ্বালা করছে যেন চোখেও ক্ষত হয়ে গেছে নোনা জল ঝরতে ঝরতে। নিদারুণ যন্ত্রণায় ছট ফট করতে করতে নিজের মনে বলে উঠল, খোদা, আরও অত্যাচার বাকী আছে? এই অপমানের চেয়ে তো মরে যাওয়া অনেক ভালো। আল্লাহ্ তুমি কি করে দেখছ? এর চেয়ে মরে যাওয়া যে অনেক ভালো। এসব ভাবতে ভাবতে আলেয়া বুকে প্রচণ্ড ব্যথা হতে থাকে। আর ভাবতে পারছে না। বার বার খেই হারিয়ে যেতে লাগলো ওর ভাবনার। কূল কিনারা খুঁজে পেল না কি করে এদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবে। একটু পরেই লোক দুটি বেরিয়ে গেল। আলেয়া শুনতে পেল ঘরের দরজায় তালা লাগান হল। একটু পরেই ও অনেক চেষ্টা করলো দরজাটি ভাঙতে, কিন্তু কিছুতেই পারলো না। বাইরে কয়েকজন লোককে কথা বলেতে শুনল। কেউ একজন এসে ওকে বাথরুমে নিয়ে গেল। আবার ঘরে ফিরিয়ে আনার সময়ে বলল, “ওদের পা ধরে ক্ষমা চাও। ভাই আসলে তাকে ওদের হাতে তুলে দেবে এমনটা বল। তাহলে হয়তো ওরা তোমাকে ছেড়ে দেবে”। আলেয়া শুধু বলল, “আপনি আমাকে ছেড়ে দেন। আপনারও তো মা, বোন আছে বাড়িতে”। লোকটি কিছু না বলে ওকে ঘরে ঢুকিয়ে আবার তালা দিয়ে দিল।
ক্লান্তিতে চোখ বুজে এসেছিল। একসময় মনে হল অনেকদূর থেকে অনেক মানুষের কথা ভেসে আসছে। ওর চোখে মুখে কেউ পানির ঝাঁপটা দিচ্ছে। চোখ একটুখানি খুলতেই দেখতে পেল, মা’র ব্যাকুল মুখটি ঝুঁকে আছে ওর মুখের উপর। ওকে চোখ খুলতে দেখে মা ওকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন । পাশ থেকে বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন, “আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে আমার মেয়েটাকে, আল্লাহ্ তুমি এই শয়তানদের বিচার কর”। আলেয়ার তখন মনে পড়লো, দুইজন পাকিস্তানি অফিসার কে নিয়ে ফিরে এসেছিল বাঙ্গালী লোক দুটি। তারপর… আর মনে করতে করতে চায়না ও। কখন জ্ঞান হারিয়েছে, কিভাবে বাড়ি এসেছে ও কিছুই যানেনা। এখন জানতে আর ইচ্ছেও করছেনা। শুধু মনে হচ্ছে মা’কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু তার আগে যে ওর নোংরা শরীরটাকে ধুতে হবে। ভীষণ ঘৃণা হচ্ছে ওর। কিন্তু এক ফোঁটাও শক্তি নেই ওর উঠে যাবার। ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
এরপর ওর জীবনটা একেবারে বদলে গেল। আলেয়া বাড়ি থেকে আর বের হতো না। কারো সাথে কোন কথা বলতো না। সারাদিন সংসারের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে শুরু করলো। আর রাত জেগে বই পড়ত। একসময় যুদ্ধ শেষ হল। ওর ভাইজান ফিরে এলো দেশ স্বাধীন করে কত আনন্দ নিয়ে। কিন্তু বাড়ি ফিরে সব শুনে বোনকে কোন সান্ত্বনা দিতে পারলো না। শুধু বলল, আমার জন্য আজ তোকে সব হারাতে হল । আমি কি করে তোকে তোর সব কিছু ফেরত দেব? আলেয়া বলে, ও যে দেশ স্বাধীন করে ফিরেছে তাতেই ওর সব পাওয়া হয়ে গেছে। ফিরে এলো ওর ভালোবাসার মানুষটিও। কিন্তু ওদের বিয়েটা আর হল না। ছেলের বাবা, মা এ বিয়েতে রাজি হলেন না । আলেয়া নিজেও ভাবল, ওদের আর কি দোষ। দোষ ওর ভাগ্যের। ও তাই ঠিক করলো ও একাই থাকবে। সমাজে তখন ওর মত মেয়েরা একঘরে হয়ে গেল। এটা যে কোন কলঙ্ক নয়, ওরা যে নিষ্পাপ সেটা আপনজনেরা বুঝত, সমাজের কিছু শিক্ষিত মানুষও বুঝত। কিন্তু, তবু যেন ওরা অস্পৃশ্য হয়ে রইলো।
আমার মা বললেন, আলেয়ার সাথে শেষ দেখা হয়েছে অনেক বছর আগে। দেশ স্বাধীন হবার পরের বছর বাবার বদলী হয়ে যায় অন্য শহরে। তারপর এর তার কাছ থেকে টুকরো খবর পেয়েছে যে,আলেয়া নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একাই থেকে গেছে। কেউ কেউ কয়েকবার কোন বৃদ্ধ, বিপত্নীকের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছে, কিন্তু আলেয়া রাজি হয়নি। বাবা, মা মারা যাবার পরে ভাইয়ের সংসারের এক কোনে জায়গা করে নিয়েছে। ৬৩ বছর বয়সী আলেয়া এখনও নিজেকে একটি সমাজ কল্যাণ সংস্থার সাথে যুক্ত রেখেছে।
হঠাৎ খেয়াল করে দেখি আমার মা’র দুচোখে পানি। আমি মা’কে জড়িয়ে ধরলাম। বললেন ওরা এত সহ্য করলো, কিন্তু ওদের প্রাপ্য সম্মান ওরা পেল না। রাষ্ট্র ওঁদের “বীরাঙ্গনা” খেতাব দিয়েছে। খেতাবে কি হবে? সম্মানই তো পেল না কোথাও! কতজন আছে শুনেছি, যারা লজ্জায় নিজেকে আড়ালে রেখেছে। কতজন অযত্নে অবহেলায়, অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। সরকার চাইলে কি পারে না এদের সমাদর করতে? অনেক প্রশ্ন বিজয় দেখা আমার মায়ের মনে। আমার কাছে সেসবের কোন উত্তর নেই। আমি ভাবছি, ৪৫টা বছর আমরা স্বাধীন হয়েছি। কত রকমের আয়োজন, উৎসবে মেতে উঠি আমরা। শুধু খেতাব দিয়ে আর বিশেষ বিশেষ দিনে তাঁদের মঞ্চে উঠিয়ে, কয়েকটা ভারী ভারী কথা বলে আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য সেরে ফেলি! এটুকুতে কি তাঁদের ঋণ আমরা শোধ করতে পারবো? আমার মানচিত্র জুড়ে এক বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন জল জল করে।
#আমি_চিত্রাঙ্গদা
৯ ডিসেম্বর, ২০১৬
গল্প ১
প্রহসন
-ইসমাত সুলতানা
আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে এমন কিছু কথা, এমন কিছু উপলব্ধি থাকে, যা কোনদিন সেভাবে কাউকে বলা যায় না। অথচ সেই সব ঘটনা আমাদের অনেকের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কারো কারো ক্ষেত্রে জীবনবোধ তৈরি করে। আবার কারো জীবনবোধ পালটেও দেয়। তেমনই কিছু ঘটনা, কিছু গল্প, কিছু ধ্যান-ধারনা নিয়েই আমার গল্প বলা।
আজকের গল্পটি যেদিন শুরু হয়েছিল তখন আমার বয়স ১৪ বছর। আমরা তিন বোন। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মেঝ বোনের বয়স ১৭ বছর। কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী। সেদিন বিকেলটাও ছিল আর সব দিনের মতোই আটপৌরে এক বিকেল। কিন্তু হঠাৎই বদলে গেল। বাড়িতে একজন প্রতিবেশী এলেন। শুনলাম তার কয়েকজন আত্মীয় আসবে আমার বোনটিকে দেখতে। অর্থাৎ কণে দেখা। এই খবরের আকস্মিকতায় আমরা খুব চমৎকৃত হলাম। মা’কে দেখলাম তড়িঘড়ি করে রান্না ঘরে ব্যস্ত হয়ে যেতে। আর বড় বোন তখন আমাদের বাড়িতেই ছিল, সে ব্যস্ত হয়ে গেল মেঝ বোনকে কোন শাড়ি পরাবে, কিভাবে সাজাবে এসব নিয়ে। মেঝ বোনের মুখ দেখে আমি বুঝিনি ওর মনের অবস্থা কি। তবে মনে হল খুশী খুশী ভাব।
কয়েক ঘণ্টা বেশ সাজ সাজ রব বাড়িতে। ছেলে পক্ষ এলো সন্ধ্যায়। সাথে ছেলেও এলো। বেশ লম্বা, গায়ের রং ফরসা, স্বাস্থ্য বেশ। মোট কথা, দেখতে, শুনতে দশাসই পাত্রটি আমেরিকা বাসি। দুই পক্ষের অভিভাবকদের মাঝে পারশপরিক কুশল বিনিময়ের পর এবার মেয়েকে দেখানোর পালা। নিয়ম অনুযায়ী মেয়েকে সাজিয়ে গুঁজিয়ে আনা হল বৈঠকখানা ঘরে। মুরুব্বিদের সালাম দিয়ে ও দাঁড়িয়ে রইলো বড় বোনের গা ঘেঁষে। আমার সুন্দরী বোনটিকে দেখতে আরও সুন্দর লাগছিল। ওরা এটা সেটা দু/তিনটে কথা বলে ওকে ভিতরে নিয়ে যেতে বলল। তারপর খাওয়া দাওয়া সেরে যাবার সময় বলে গেল ওদের মতামত পরে জানিয়ে দেবে। বাড়িতে সবাই তখন বেশ আনন্দিত। ছেলেটিকে নিয়ে জল্পনা, কল্পনা চলছে। কিন্তু বাবা, মা’কে বেশ চিন্তিত। কি হয়, কি হয়! এরপর শুরু হল অপেক্ষার পালা। বেশ কয়েকদিন চলে গেল কোন খবর নেই। অবশেষে খবর এলো, এখানে বিয়ে হবে না। ওরা কারণটা বলেনি। এটুকুই যথেষ্ট ছিল আমাদের বাড়ীর সবার মন খারাপ হবার জন্য। মা, বাবা, নিজেরদের মনের অবস্থা আমাদের বুঝতে দিলেন না। বললেন, “ও কিছু না, এমন হতেই পারে। আল্লাহ্ যা করেন, মঙ্গলের জন্য করেন”। কিন্তু বোঝা গেল না আসলে তাদের যে কতটা খারাপ লেগেছিল। আর বোঝা গেল না আমার বোনটির মনের অবস্থা। ও বরাবরই কম কথা বলত। এই ঘটনার পর যেন ও আরও চুপচাপ হয়ে গেল। আমি এটুকু বুঝলাম, ওর মন খারাপ হয়েছে। কয়েকদিন পরে সব কিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলতে লাগলো। কিন্তু অনেক বড় দাগ কেটে গেল আমার ১৪ বছরের মনে। মনে হল, এভাবে মেয়েদের উপস্থাপন করাটা খুব অপমানকর। বহু বছর ধরে এই নিয়মই চলে আসছে। তখন সমাজে মেয়ের মতামত দেয়ার কোন সুযোগ ছিল না। অথচ, ছেলে নির্দ্বিধায় একের পর এক মেয়ে দেখেতে যেত। সেই বয়সে আমি এটুকু বুঝেছিলাম, কোন মেয়েরই এমন অপমানকর পরিস্থিতিতে পড়া উচিত নয়। মেয়েদেরও একই অধিকার থাকা উচিত।
বাঙ্গালী সমাজ এখন অনেক এগিয়ে গেছে, অনেক পুরনো নিয়ম বদলে গেছে। মেয়ে দেখা দেখির নিয়মও বদলেছে। এখন মেয়েরাও ছেলে দেখে। প্রত্যাখ্যানও করে। কিন্তু, আজও বিয়ের পরে মেয়েটিকে নিজের সবকিছু ছেড়ে ছেলের বাড়িতেই যেতে হয়। ছেলেকে আসতে তো হয় না। এই কঠিন, নিষ্ঠুর নিয়মেরও বদল হওয়া দরকার। আমরাই পারি এসব পুরনো, নিষ্ঠুর নিয়ম বদলে নতুন নিয়মের প্রবর্তন করতে, যেখানে কেউই ছোট হবে না। আদ্যিকালের সমাজে হয়তো এমনটি প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এই একবিংশ শতকে সেই একই নিয়মে মেয়েদেরই কেন এত বড় আত্মত্যাগ করতে হবে? সমাজপতি বলে কেউ নেই। এটি কোন আইন নয়, এটি সামাজিক ব্যবস্থা। আপনাকে, আর আমাকেই নিতে হবে সামাজিক নিয়মগুলোকে আরও মানবিক করার দায়িত্ব।
#আমি_চিত্রাঙ্গদা
২৯ নভেম্বর, ২০১৬
__________________________
Share |